ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ তার প্রথম ভাষণে কেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নাম উল্লেখ করেননি, সেই প্রশ্নে আজ পার্লামেন্টে তুমুল বিতন্ডা হয়েছে।
বিরোধী কংগ্রেসের অভিযোগ, বর্তমান সরকার শুধু নেহরুর আদর্শ ও দর্শন থেকে সরেই আসছে না – আধুনিক ভারতের এই রূপকারকে পদে পদে অপমানও করছে।
জবাবে বিজেপি বলছে, নেহরু ছাড়াও ভারতে আরো অনেক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন যাদের ভাবনা এতদিন গুরুত্ব পায়নি – তারা শুধু সেই ত্রুটিটাই শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
নেহরুর পররাষ্ট্রনীতিও আজকের দুনিয়ায় প্রাসঙ্গিক নয় বলেই দাবি করছেন তারা। কিন্তু নেহরুকে ঘিরে আচমকা ভারতে কেন এই বিতর্ক?
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ গতকাল পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে যে ভাষণ দেন তাতে নেহরুর মন্ত্রিসভার দুই সদস্য, সর্দার প্যাটেল ও বি আর আম্বেদকরকে শ্রদ্ধা জানালেও তিনি একবারও নেহরুর নামই করেননি।
ভাষণে জাতির জনক গান্ধীজির সঙ্গেই এক নি:শ্বাসে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিজেপির তাত্ত্বিক গুরু দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম। রাজ্যসভায় আজ এরই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে কংগ্রেস।
দলের নেতা আনন্দ শর্মা বলেন, “যেভাবে মহাত্মা গান্ধীকে ছোট করা হচ্ছে, নেহরুর অবদানকে মুছে দেওয়া হচ্ছে কিংবা তাদের সঙ্গে তুলনা টানা হচ্ছে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের – সেটা কিছুতেই মানা সম্ভব নয়। এই সরকার দীনদয়ালের শতবর্ষ পালন করলেও ইন্দিরা গান্ধীর শতবর্ষ পালনে তাদের কোনও আগ্রহই নেই।”
জবাবে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পাল্টা অভিযোগ করেন, টিভি ক্যামেরার নজর পেতেই কংগ্রেস এই জাতীয় চটকদার কথাবার্তা বলছে।
তুমুল তর্কাতর্কির পর সেই বিতন্ডা তখনকার মতো থামলেও ভারতের বর্তমান সরকার যে জহরলাল নেহরুর আদর্শ থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত, কংগ্রেস সেই অভিযোগ থেকে কিন্তু সরে আসছে না।
দলের বর্ষীয়ান এমপি প্রদীপ ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলছিলেন, নেহরুভিয়ান দর্শনের দুটো মূল স্তম্ভ – ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদই আজকের ভারতে সবচেয়ে বিপন্ন।
“এক বিখ্যাত লেখকের প্রশ্নের জবাবে নেহরুজি একবার বলেছিলেন স্বাধীন ভারতে তার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হল দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা আর বহু ধর্ম-বহু সংস্কৃতির মিলনে যে সংমিশ্রণ তৈরি হয়েছে সেটাকে রক্ষা করা।”
“কিন্তু বর্তমান সরকার আসার পর ভারতের সেই বহুত্ববাদকে তারা কোনও মর্যাদাই দিচ্ছে না। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে যেমন সমাজের সব কিছু ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল ভারতেও এখন যেন সেই ধরনেরই চেষ্টা চলছে”, বলছিলেন প্রদীপ ভট্টাচার্য।
বিজেপি-র পলিসি রিসার্চ গ্রুপের অনির্বাণ গাঙ্গুলি আবার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন – অন্য রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা কংগ্রেস আমলে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, এখন সেই ভুলটাই শোধরানোর পালা চলছে।
“দেশ গড়ার দর্শন তো নেহরু শুধু একা দেননি – শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, দীনদয়াল উপাধ্যায় কিংবা ওদিকে রামমনোহর লোহিয়া-আম্বেদকরের মতো অনেকেই দিয়েছেন। নেহরু নিজেই মারা গেছেন পঞ্চাশ বছরের ওপর। তার চিন্তাধারা তো এমন কোনও স্ট্রেইট জ্যাকেট নয় যে তাতে কাটছাঁট করা যাবে না বা সেটা ফেলে আসা যাবে না!”
“মুশকিল হল কংগ্রেস তাদের ষাট বছরের শাসনে নেহরু ছাড়া অন্য কোনও চিন্তাবিদকেই যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। আমরা এখন সেটা থেকেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি”, বলছিলেন অনির্বাণ গাঙ্গুলি।
কংগ্রেস আবার বলছে – নেহরুর বিদেশনীতি থেকে সরে আসার জন্যও আজকের ভারতকে চড়া দাম দিতে হতে পারে।
প্রদীপ ভট্টাচার্যর কথায়, “নেহরুর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল সহাবস্থান ও সহযোগিতা। পৃথিবীর সব দেশ, বিশেষ করে ক্ষমতাধর দেশগুলোর সবার সঙ্গেই তিনি একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন। এখন সেই ব্যালান্সটাই আর নেই!
“আমি তো খুবই চিন্তিত ভারত যেভাবে চীনের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধে নেমে পড়েছে … আর সেই সঙ্গে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েছে আমেরিকার দিকে। ভাবখানা এমন যেন আমাদের বিপদে আমেরিকা এসে রক্ষা করবে!”
জবাবে বিজেপির সাফ কথা – পন্ডিত নেহরুর পঞ্চশীল বা নির্জোট আন্দোলনের নীতি আজকের ভূরাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকই নয়।
অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলছিলেন, “পঞ্চশীল করে আমরা কী পেয়েছি? বাষট্টিতে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ – আর আকসাই চীন তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। ফলে নির্জোট আন্দোলনের যুগ, নির্জোট আন্দোলনের ভাবনাটাই এখন চলে গেছে।
“ভারত এখন বিশ্বে নানা প্র্যাগম্যাটিক অ্যালায়েন্স গড়তে চাইছে। আমরা একটা সক্ষম, স্বনির্ভর দেশ – আর বিশ্বে আমাদের সেই প্রাপ্য মর্যাদা যাতে পাওয়া যায়, তার ওপর ভিত্তি করেই নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতি গত তিন বছরে এগিয়েছে।”
ড: গাঙ্গুলির এই কথা থেকেই স্পষ্ট, নেহরুভিয়ান দর্শন থেকে বিজেপি সরকার সম্পূর্ণ উল্টোপথে হাঁটছে – আর তা নিয়ে কোনও লুকোছাপাও রাখা হচ্ছে না।
আধুনিক ভারত গঠনে জহরলাল নেহরুর ভূমিকা যাই হোক বা তা নিয়ে যাই বিতর্ক থাক – তারা খুব সচেতনভাবেই সেটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছে।