আমাদের এই উপমহাদেশে মুসলিম নারী জাগরণের ইতিহাসে অনেকেরই অবদান আছে। বেগম রোকেয়াকেই আমরা বেশিরভাগ চিনলেও তার আগেও জানা যায় ফয়জুন্নেসা, করিমুন্নেসাদের নাম। বেগম রোকেয়াই মূলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সামনে নিয়ে আসেন।বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে নারী অধিকার আদায় বা নারীবাদ হয়ে পড়েছে শহরকেন্দ্রিক। এই শহরকেন্দ্রিক নারী আন্দোলনের কর্মীরা আবার বেগম রোকেয়াকে নিয়েও সমালোচনা করে থাকেন। বিষয়টা এমন যেন, বেগম রোকেয়া মাথায় ঘোমটা দিতেন বলেই তিনি নারীবাদী হতে পারেন না। এসব নিয়ে যারা কেতাবি তর্ক করে থাকেন, আমি মনে করি, তারা খুব বেশি মাথা খাটাতে রাজি নন। বেগম রোকেয়ার সময় বাস্তবতা এবং সেই সময়কার সমাজ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে যদি কেউ তার লড়াইকে বিবেচনা করতে চান, তাদের কাছে ঘোমটা পরা না পরাটাই বড় বিষয় হবে।
আবার অনেককে এও বলতে শোনা যায় যে, বেগম রোকেয়া তার স্বামীর জন্য সংসারে আপস করেছিলেন তাই তিনি সঠিক নারীবাদী হতে পারেন না। কতটা ‘ভার্চুয়ালি’ নারীবাদকে বুঝলে এসব নিয়ে তর্কে লিপ্ত হতে পারে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। সংসার করার সঙ্গে নারী আন্দোলনের কোনও বিরোধ আছে কিনা, আমার জানা নেই।
পুস্তকি নারীবাদ বলতে মূলত এ ধরনের ‘ভার্চুয়াল’ জ্ঞানীদের জন্যই প্রযোজ্য। যাদের কাছে বাহ্যিক প্রকাশই কেবল কাউকে বোঝার মাধ্যম কিন্তু তার লড়াই সংগ্রাম বা বৃহত্তর অবদানকে তারা এক কথায় উড়িয়ে দিতে চান এই ছোটখাটো বিষয়ের আবর্তে।
একটা সময় আমাদের দেশে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতো অনেক নারী সংগঠন। যাদের মধ্যে মহিলা পরিষদসহ আরও কিছু সংগঠনের রয়েছে প্রচুর লড়াইয়ের ঐতিহ্য। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বাইরে এই একটি প্রতিষ্ঠান সারাদেশে গড়ে তুলেছিল তাদের সচেতনতার আন্দোলন। নারীর সচেতনতা, কথা বলার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন বছরের পর বছর এবং এ ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর সাফল্যের উদাহরণ।
আপনি যে উদ্দেশ্য নিয়েই লড়াই করেন না কেন তার প্রতিষ্ঠার জন্য যদি সাংগঠনিক উদ্যোগ না থাকে তবে একা একা কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিছু ফলোয়ার তৈরি করতে পারবেন কিন্তু সেটা পরবর্তনে কতটা ভূমিকা রাখবে বলা মুশকিল।
তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথমেই দরকার ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সাংগঠনিক লড়াইয়ের উদ্যোগ। বর্তমানে আমাদের দেশে এটারই বিরাট ঘাটতি।
‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ বিয়ের বয়সসীমা শিথিল করে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন পাস করেছে বাংলাদেশের আইনসভা। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল করে নতুন আইন হলো এটি।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিলটি সংসদে ওঠে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর। তখন বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
এখানে এই প্রসঙ্গটি আনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই যে একটি বিপজ্জনক আইন সরকার পাস করে ফেলেছে, সেটি নিয়ে কি আমরা দেশব্যাপী নারীদের সচেতন করাসহ আইন প্রতিরোধে কোনও আন্দোলন সংগ্রামের তথ্য জানি? বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কথাবার্তা ছাড়া এ নিয়ে কারও কোনও সাংগঠনিক কার্যক্রম আমরা দেখিনি, যা সরকারকে ভাবতে বাধ্য করতে পারে।
তার মানে আমাদের দেশে মাঠের নারী আন্দোলন অনুপস্থিত। সরকার তার ক্ষমতা রক্ষায় যা যা করণীয় তাই করবে, এটাই হচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সরকারের রাজনীতি। সেখানে যদি শক্তভাবে তার প্রতিবাদ না করা যায়, তাহলে কার্যকর কিছু প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যে নীতিটি সরকার পাস করালো, এর যে কী ভয়াবহ পরিণাম আমাদের সমাজে আসতে যাচ্ছে, এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কোনও কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়ছে না।
সমাজে যখন নারীনীতি, নারী অধিকার, নারীবাদ এসব নিয়ে একধরনের নেতিবাচক প্রচারণা চলমান, তখন কেবল মুখে মুখে আমি একজন নারীবাদী, তমুক নারীবাদী না বা কিছু কথার মাধ্যমেই নিজেকে প্রতষ্ঠা করতে চাওয়া বাস্তবে দীর্ঘমেয়াদি কোনও ফল তৈরি করে না। সম্প্রতি আমাদের সমাজে বাকসর্বস্ব নারীবাদের বিস্তার আছে কিন্তু কার্যকর কিছু প্রতিষ্ঠার নেই কোনও চেষ্টা বা দায়বোধ। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ নারীবাদী হতে পারে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আপনার মতের পক্ষে একটা সামগ্রিক বাস্তবতার জন্য কাজ করে যাবেন।
এই মুহূর্তে আমাদের নারীদের জন্য দরকার মাঠের নারীবাদকে প্রতিষ্ঠা করা, মুখের নারীবাদ নয়।
লীনা পারভীন
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়