Latest News
ফেনীতে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে শিক্ষার্থী নিহত
মে ১৯, ২০২৪
বান্দরবানে বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
মে ১৯, ২০২৪
গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ৪
মে ১৯, ২০২৪
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
« জয়নাল আবেদীন »
দারিদ্র বিমোচন, দরিদ্র ও অসুবিধাগ্রস্থ ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি বৃদ্ধি এবং নারী-পুরুষের সমতা বিকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ‘পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন-পিডিবিএফ’। প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরে উদ্দেশ্য কতটা পূরণ হয়েছে সেই প্রশ্ন তো আছেই; তার চেয়েও বড় প্রশ্ন সংস্থাটির বর্তমান এমডির বৈধতা কতটুকু?
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে নিউজ১৯৭১। ১৯৯৯ সালের ১০ নভেম্বর প্রকাশিত গেজেটের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা পিডিবিএফের পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের কার্যকলাপের নথিপত্র ঘেঁটে প্রমাণ হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহবুবুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর!
পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন আইন ১৯৯৯-এর ১১ নম্বর ধারা বলছে, ‘ফাউন্ডেশনের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকিবেন যিনি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত শর্তাধীনে নিযু্ক্ত হইবেন। একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচন করা হইবে।’
অথচ তিন বছর আগে মাহবুবুর রহমানকে এমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো মাত্র একদিনের আয়োজনে! এর নেপথ্যে তৎকালীন সমবায় সচিব ও বোর্ড চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার। তিনি অবসরে যাবেন। তাই অবসরগ্রহণের একদিন আগেই আয়োজন করেন পিডিবিএফের এমডি নিয়োগের। আর, অবসরে যাওয়ার দিনই এমডি হিসেবে নিয়োগ দেন মাহবুবুর রহমানকে।
সরকারি চাকরিতে এমন রকেট গতির নিয়োগ অবিশ্বাস্য এবং অভুতপূর্ব। শুধু তাই নয়। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিয়োগটি দেওয়া হয়েছে স্থায়ীভাবে। অথচ এই পদটি চুক্তিভিত্তিক। অনিয়মের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে এই এমডি তোয়াক্কা করেন না উচ্চ আদালতের রায়ও!
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রশান্ত কুমার রায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘সরকার পল্লী উন্নয়ন ও দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য পিডিবিএফ প্রতিষ্ঠা করেছে। কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য নয়।’
কানাডার সাহায্য সংস্থার সহায়তায় ক্ষুদ্র ঋণ বিতরনী সংস্থা হিসেবে শুরু হয় পিডিবিএফের। ১৯৯৯ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইন বলছে, সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ হবেন চুক্তিভিত্তিক। কিন্তু ২০১৩ সালে মাহবুবুর রহমানকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান তৎকালীন সমবায় সচিব পিডিবিএফের বোর্ড চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার।
সূত্র জানায়, একটি সভার মাত্র দেড় মাসের মাথায় আরেকটি জরুরি বোর্ড সভা ডেকে ২০১৩ সালের ১২ মে এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। পরদিন ১৩ মে সকালেই এমডি হিসেবে যোগদান করেন মাহবুবুর রহমান। আর সেটি গ্রহণ করেন মিহির কান্তি মজুমদার। কেননা সেদিনই ছিলো সচিব মিহির কান্তির চাকরির শেষদিন। তই দ্রুত গতিতে শেষ করেন নিয়োগ প্রক্রিয়া।
জানা গেছে, তিনি (মাহবুবুর রহমান) ম্যানেজার (লজিস্টিক) হিসেবে আবেদন করলেও তাকে মানবসম্পদ ম্যানেজার হিসেবে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিষয়টি ফাপাড অডিটে ধরা পড়ায় অডিট কমিটি তার নিয়োগ বাতিলের জন্য সুপারিশ করেছিলেন।
এই রকেট গতির অবৈধ এমডি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো উঠে আসে একটি অডিট রিপোর্টে। সেখানে মাহবুবুর রহমানের নিয়োগ বাতিলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, উল্টো ‘যোগ্য’ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাকে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, নিয়োগের জালিয়াতি ধামাচাপা দিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই এই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। অথচ এত বড় একটি সংস্থার শীর্ষ পদে নিয়োগের বিষয়টি গেজেটাকারে প্রকাশ হওয়ার কথা। বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসার পরে অবশেষে প্রকাশ করা হয় গেজেট। তাও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অন্ধকারে রেখেই।
এদিকে, পিডিবিএফের বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া চার কর্মকর্তাকে নিজেদের পদে যোগদান করার পক্ষে সম্প্রতি রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু তাদের ভবনেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এখানেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছেন অবৈধ এমডি মাহবুবুর রহমান।
সেই চার কর্মকর্তার একজন ফজলুল হক খান (সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি) জানান, একাধিকবার চেষ্টা করার পরেও তারা পিডিবিএফ কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমাদের যোগদানপত্র রিসিভ করতেও নারাজ বর্তমান এমডি। পিডিবিএফের মতো প্রতিষ্ঠান সু্প্রীম কোর্টের অর্ডারও মানেন না। এটি খুবই দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ধীরাজ কুমার নাথ বলেন, ‘পিডিবিএফে এমডি পদে স্থায়ী নিয়োগের তো কোনো সুযোগই নেই। আর এটি কোনো রেগুলার ফ্যাক্টরি না। এত তাড়াহুড়ারও কিছু নেই। আমি মনে করি, সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।’
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হলেও মাহবুবুর রহমানের সাক্ষাত পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনেও তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
পিডিবিএফে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১২ মে অনুষ্ঠিত বোর্ডের ৬১তম সভায় মাহবুবুর রহমানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। বিষয়টি অবহিত করে মাহবুবুর রহমানকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। তৎকালীন সমবায় সচিব ও বোর্ড সভাপতি মিহির কান্তি মজুমদার স্বাক্ষরিত ওই চিঠি ইস্যু করা হয় ১৩ মে।
সেখানে একটিপর্যায়ে বলা হয়, ‘আপনাকে আগামী ১৩/০৫/২০১৩ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে বোর্ডের সভাপতি (চেয়ারম্যান) বরাবর যোগদানপত্র দাখিল করার জন্য বলা হলো।’ মজার ব্যাপার হলো- বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত যেদিন চিঠি আকারে মাহবুবুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়, সেদিন সকালেই সভাপতির কাছে যোগদানপত্র দাখিল করেন তিনি। একটি সংস্থার এমডির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন রকেট গতি সবাইকে বিস্মিত করেছে।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব প্রশান্ত কুমার রায় পদাধিকার বলে পিডিবিএফের বোর্ড চেয়ারম্যান। তিনি গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির কার্যক্রম পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে জানতে চান যে পিডিবিএফের এমডি পদটি স্থায়ী কি-না। জবাবে এমডি মাহবুবুর রহমান ‘হ্যাঁ’ বললে বিস্মিত হন সমবায় সচিব। পাল্টা উত্তরে তিনি জানিয়ে দেন এ সংক্রান্ত আইনের ব্যাখ্যা।
জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ২৩ নম্বর আইনের ১১ (১-৬) ধারা অনুযায়ী এমডি নিয়োগের কথা বলা আছে। ওই আইনের ২৯ (১-২) ধারা অনুযায়ী ‘প্রবিধান মালা প্রণয়ন করিবে এবং ওই তারিখ হইতে তা কার্যকর হইবে’।
সমবায় সচিবের তোপের মুখে খেই হারিয়ে ফেলেন রকেট গতিতে নিয়ম ও আইন বহির্ভূতভাবে এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মাহবুবুর রহমান। এমডি নিয়োগের যে গেজেট প্রকাশ হয়নি দীর্ঘ তিন বছরেও, সেটি তড়িগড়ি করে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। অবশেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর সেই গেজেটটি প্রকাশও করেন। সেখানে সই করেন মাহবুবুর রহমান। কিন্তু এই গেজেট প্রকাশের ক্ষেত্রে লুকোচুরি আর আইনের প্রতি চরম অবমাননার অভিযোগ আছে।
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারের যে কোনো গেজেট প্রকাশের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন থাকতে হবে। এমনকি গেজেট প্রকাশের বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু পিডিবিএফের এমডি নিয়োগের যে গেজেট তিন বছর পরেই প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে একেবারেই অন্ধকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
গেজেট প্রকাশে অনিয়মের বিষয়টি গোচরে এলে আবারও নড়েচড়ে বসেন সমবায় সচিব প্রশান্ত কুমার রায়। এবার গেজেট বাতিলের গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নেন মাহবুবুর রহমান। ৬ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত গেজেটটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। সেটিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আড়ালে রেখেই বাতিল করেন। এই অবস্থায় এমডি মাহবুবুর রহমানের এমডি পদে থাকা সম্পূর্ন বেঅাইনি, ও অবৈধ।
এভাবে একের পর এক জালিয়াতি আর অনিয়মের পাহাড় গড়েছেন মাহবুবুর রহমান। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে হরিলুটের কারখানা গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানকে হাতের মুঠোয় পুরে রাখার যত কৌশল, সবই একে একে প্রয়োগ করে যান তিনি। বিপরীতে গরীব মানুষেরা দারিদ্র্যতার মধ্যেই আটকে থাকেন বছরের পর বছর।
Our facebook page