Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
গত ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধান আইন (সপ্তদশ সংশোধন) ২০১৮-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলে সংবিধানে সপ্তদশ সংশোধনী এনে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার পথ খুলল। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর এ উদ্যোগ নিল সরকার। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় এখন এটি বিল আকারে উত্থাপন করবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে যাচাই-বাছাইয়ের পর তা পাস হবে। আমরা জানি, সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে এবং তা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের রয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ওই সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ বৃদ্ধি হয়। এই হিসাবে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী সদস্যদের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ জনে উন্নীত করা হলেও তখন বিধানটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। এবার সরকার মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিল। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রথম সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ১৫টি। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত দ্বিতীয় সংসদে তা বাড়িয়ে ৩০টি করা হয়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সংসদেও সংখ্যা একই ছিল। কিন্তু আইনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে গঠিত চতুর্থ সংসদ ছিল সংরক্ষিত নারী আসনবিহীন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পঞ্চম সংসদে আইন পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে আবার ৩০টি সংরক্ষিত নারী আসন ব্যবস্থা সংসদে বহাল হয়। ১৯৯৬ সালের সংসদেও এই ৩০টি আসনই ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর গঠিত অষ্টম সংসদে আবার সংরক্ষিত নারী আসন ছিল না আইনের কার্যকাল শেষ হওয়ার কারণে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নবম সংসদে সংরক্ষিত নারী ছিল ৪৫টি। ২০০৪ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসন ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়েছিল। অবশেষে ২০১১ সালে ৪৫ থেকে বেড়ে তা দাঁড়ায় ৫০-এ, যা বর্তমান সংসদ পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নারীসমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। এই ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য, যা আজও ফুরায়নি। মাত্র ১৫টি আসন নিয়ে এই ব্যবস্থার সূচনা হলেও ক্রমশ বেড়ে এই আসনসংখ্যা সংসদে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল মিলে মোট ৫০-এ দাঁড়ায়। নির্বাচিত নারীরা এ পদে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করার এটি একটি পথ। তবে আমি এও মনে করি যে, সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হলে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ার পথটি আরও প্রশস্ত করা সম্ভব। আমাদের সমাজে এ দাবি যথেষ্টই পুষ্ট যে, সংসদ নির্বাচনে নারীদের জন্য সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা। আমি এই দাবির সঙ্গে একমত। এ কথা অসত্য নয় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের শীর্ষ স্তরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে হলে শুধু সংরক্ষিত নারী আসন ও এর মেয়াদ বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নারীর ক্ষমতায়ন করা বেশ কঠিনই বটে। নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আমাদের করণীয় রয়েছে আরও অনেক কিছু। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যাপারে এই অভিমতও রয়েছে যে, এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হবে না। এই বক্তব্যের সঙ্গেও দ্বিমত প্রকাশ করি না। কিন্তু একই সঙ্গে আমি এ কথাটুকু বলতে চাই- এর মধ্য দিয়ে নারীকে ক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সম্পৃক্ত করে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ সংকুচিত মাত্রায় হলেও সৃষ্টি হয়েছে।
সংসদ নির্বাচনে যে দল যত আসন পায়, সেই সংখ্যার আনুপাতিক হারে সংরক্ষিত আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের অভিমত, এর ফলে মূলত ক্ষমতাসীন দলই এতে বেশি লাভবান হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে যে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি রয়েছে, এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র অর্থাৎ সব পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ নারীর নেতৃত্বদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন আন্তরিকতার সঙ্গে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দরকার শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা। আমাদের সামগ্রিক বাস্তবতার নিরিখে রাজনীতির মূলধারায় বা নেতৃত্বে নারীকে নিয়ে আসা প্রয়োজন- এই উচ্চারণ ইতিমধ্যে কম হয়নি। কিন্তু এ লক্ষ্যে কাজ খুব কতটা হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ রকম অভিযোগ আমরা প্রায়ই শুনি যে, সংরক্ষিত নারী আসনের নারী সংসদ সদস্যরা তাদের সংসদীয় এলাকায় কাজ করতে গিয়ে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন। তাদের কাজের সুযোগও সীমিত। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। রাজনীতিতে নারীর প্রবেশগম্যতা ঘটাতে বিভিন্ন দেশে যেসব কৌশল ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র চর্চার প্রসার ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নে নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ অনেকটা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তবে গণতন্ত্রের বিকাশ কিংবা সার্বিক প্রয়োজনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার।
সংসদের সাধারণ ৩০০ আসনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারী প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সুযোগ তেমন একটা নেই এবং অনেকের বক্তব্য হচ্ছে- বাস্তবতাই সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে নারী সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদের সাধারণ আসন ও সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের মধ্যে কোনো পার্থক্য না থাকলেও সাধারণ সদস্যদের কারও কারও সংকীর্ণ মনোভাবের কারণে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা বৈষম্যের শিকার এবং এলাকার উন্নয়নে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ খুব কম। এই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এর নিরসন করতে না পারলে নারীর ক্ষমতায়নের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় লাভ সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়নের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংসদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হলেও এ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে, তা দূর করতে না পারলে রাজনীতিসহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। এসব ত্রুটি কাটিয়ে ওঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এ জন্য সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণের পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতি, প্রশাসন ও বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অবস্থান নারীর অগ্রযাত্রার ইঙ্গিতবহ। তার পরও সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সব শ্রেণির নারী এখনও সমভাবে এগিয়ে যেতে পারছেন না, তা অসত্য নয়। তবু নারী তার সুদীর্ঘ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে আপন মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে এবং শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন দূর করার ক্ষেত্রে আজ অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছে। নারী দিবস ও নারী আন্দোলনকে তার রাজনৈতিক তাৎপর্যে মূল্যায়ন করার যে কথা বলা হয়, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নারী নেতৃত্ব যে নতুন পথ দেখাতে পারে, এমন দৃষ্টান্তও আমাদের সামনেই রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়ন এবং অধিকারের প্রশ্নে আমাদের অর্জন একেবারে নগণ্য বলার সুযোগ নেই। নারীর অধিকার আদায় ও ক্ষমতায়নের পথ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মসৃণ করতে হলে পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে উদার চিত্তে।
কথাসাহিত্যিক।
নোট: সমকাল থেকে নেয়া।
Our facebook page