Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
অনীক রায়হান :
আমাদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা আছে যে, সব বাঙালিই বয়ঃসন্ধিতে এক আধটা কবিতা, চিঠি ইত্যাদি লিখে থাকে। প্রচলিত এ ধারণাটির প্রকৃত উৎস কী, তা নিজের মধ্যেও বেশ কিছুদিন আলোড়িত হয়েছিল। ঘটনা প্রসঙ্গে একদিন শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ বিষয়ে আপনার কী মনে হয়, কারণটা কী? সুনীলদা উত্তর দিয়েছিলেন যে আসলে আমাদের শিশুসাহিত্য খুব শক্তিশালী।
আমাদের শিশু সাহিত্য শক্তিশালী ও ঐশ্বর্যময় বলেই আমাদের ভিতর এক ধরণের সাহিত্যবোধ দেখা যায়। হয়তো বাঙালির সাহিত্যমনস্কতার নেপথ্যে শিশু সাহিত্যের এ ভূমিকাটি অন্যতম, মেনে নিতে দ্বিধা নেই। অথচ, আশ্চর্যরকমভাবে শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা অবহেলিত, খানিকটা দ্বিতীয় শ্রেণির সাহিত্যিক বলেই তাদের গণ্য করা হয়। কেবলমাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রমী নাম স্মরণে রয়েছে আজ। আশ্চর্য এ উপেক্ষিত অবস্থানটিকে নিয়েই ক াজ করার একটা ইচ্ছে ছিল দীর্ঘদিন ধরে। শিশুসাহিত্যের জন্য এক সময়ে যাঁরা প্রাণপাত করেছেন, প্রাক স্বাধীনতা পর্বে তাঁদের মহৎ প্রয়াস ও উদ্দেশ্যকে বিনম্র শ্রদ্ধায় একবার ফিরে দেখার তাড়নায় বলাকা সাহিত্য পত্রিকার এ প্রয়াস।
শিশুসাহিত্য শব্দটি নিয়ে আলোচনা কম হয়নি বাংলা সাহিত্যে। কারা শিশু, কাদের জন্যই বা লেখা আর কারাই বা শিশুসাহিত্যিক, এ নিয়ে আজও বিভিন্ন ধরণের মত সক্রিয়। ‘শতাব্দীর শিশু–সাহিত্য’ গ্রন্থে খগেন্দ্রনাথ মিত্র নিজস্ব মতামত দিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমরা বিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীগণের উদ্দেশ্যে রচিত সাহিত্যকেই শিশু–সাহিত্য বলার পক্ষে’। এ বিষয়ে বয়স অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগের পক্ষপাতী কেউ কেউ। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের মিশুসাহিত্য সম্পর্কে এ মত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে, শিশুসাহিত্য অন্য একটি ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়। শিশু–কিশোর বয়সে যে আনন্দ ও কৌতূহল নিয়ে বিষয়টিকে দেখা হয়, বড় বয়সে সেই বিষয়টি ভাবনার সাম্রাজ্য খুলে দেয়। সুকুমার রায় বা রবীন্দ্রনাথের এমন রচনা প্রচুর। তাই শিশু–সাহিত্য বলতে নির্দিষ্ট কোনো পাঠককে না বুঝিয়ে বরং বলা ভালণ্ড যাদের ভিতর চিরকালের একটা চলমানতা থাকে; তাদের জন্য রচিত সাহিত্যই শিশু সাহিত্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সব বড়দের ভিতরে যে ছোটবেলা থাকে, সেই ছোটবেলার জন্যই শিশু–সাহিত্যের জন্ম। তাকে কেন্দ্র করেই নির্মাণ; কিন্তু পরিধিটি ক্রমবর্ধমান, যে গ্রহণ করতে পারবে তারই। তাই শিশুসাহিত্য সময় ও স্থানের ভিতর তৈরি হওয়া একটি বহৃমাত্রিক সম্ভাবনা। যা নিজে জেগে থাকে, অন্যকেও জাগিয়ে রাখে।
এক সময় পাঠ্যবই থেকে সরে এসে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব পথ তৈরি করছিল। নীতিশিক্ষামূলক গল্পের সৌধ থেকে ছড়িয়ে গেল সাহিত্যের অন্য ভুবন। মূলত, বিদ্যাসাগরের তিরোধানের পর থেকেই শিশু–সাহিত্যে ভিন্ন একটি জগৎ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঠ্যবই–এর বাইরে দাঁড়িয়ে শিশুদের জন্য এমন ভাবনার কথা অবশ্য হরিনাথ মজুমদার ভেবেছিলেন সেই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দেই। বিজয়বসন্তের আত্মপ্রকাশ সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই, যদিও ভাষা ও অন্যান্য অনেক কারণেই বিজয়বসন্ত পাঠ্যগ্রন্থের বাইরে যথার্থ অর্থে শিশুদের জন্য সম্পূর্ণভাবে রচিত এ কথা বলা যায় না। তবু বাংলা সাহিত্যে সেই প্রথম আভাস দেখা গেল, যদিও তা ছিল বিদ্যাসাগরের তিরোধানের প্রায় তিরিশ বছর আগে। বালক–বালিকাদের জন্য সেই সময় যে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তার নাম ‘সখা’। সখা মাসিক পত্রিকা। এ পত্রিকাটির প্রকাশ বাংলা শিশু–সাহিত্যের অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন প্রমদাচরণ সেন। তাঁর মৃত্যুর পর সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। পরবর্তীক্ষেত্রে এ পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত হতে দেখা গেল শিশু সাহিত্যিক নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে। এ সময়টি ছিল বাংলা শিশু–সাহিত্যের যথার্থ উন্মেষপর্ব। কারণ, এর পরই আত্মপ্রকাশ করে ‘বালক’, ‘সাথী’, ‘মুকুল’, ‘সন্দেশ’, ‘মাসপয়লা’, ‘মৌচাক’ ও অন্যান্য আরও অনেক অনেক পত্রিকা।
এ সমস্ত বিষয়ের ওপর নজর দিতেই দেখা গেল যে, ১৮৮৩তে ঢাকা থেকে ‘বালিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার গুপ্ত। যে সময়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিভিন্ন সংস্কারে আবদ্ধ ছিল, সেই সময়ে ‘বালিকা’ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশ নিঃসন্দেহে একটা জাগরণ বলা যায়। যদিও এ পত্রিকাটির প্রকাশিত সব সংখ্যা আর প্রায় কোনো গ্রন্থাগারেই নেই। এ ভাবেই বাংলা শিশু–সাহিত্যের জগৎ ক্রমশ বিস্মৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। দেখা গেল, প্রবাদপ্রতিম সেই সব মানুষেরা লিখে চললেন শিশুদের জন্য এক নাগাড়ে। স্পষ্ট হয়ে উঠলেন বঙ্গ শিশু–সাহিত্যে অনেকেই। প্রকাশিত হতে লাগল একের পর এক পত্রিকা। বেরোতে লাগল শিশুদের জন্য রচিত গ্রন্থ। কারও রচনা বেরোতে লাগল শুধু পত্রিকাতেই, গ্রন্থ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি সেগুলো। হয়তো আজকের নিরিখে তারা খানিকটা অস্পষ্ট বা গৌণ থেকে গেলেন। বাঙালি পাঠক পেয়ে গেল রূপকথার সাম্রাজ্য। আমাদের ঐতিহ্যের অনুসন্ধান ধরেই বাঙালির শিশু সাহিত্যে এসে গেল ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরমার ঝোলা, ঠাকুরদাদার ঝোলা ইত্যাদির সম্ভার। মনের দিগন্তে তখন রূপকথার মেঘ। শিশু সাহিত্যের এ ধারা ক্রমশ ছড়িয়ে গেল। আর তারই সঙ্গে উঠে এল একটি বিশেষ ধরণের রচনাসম্ভার, যেখানে শিশুকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি হল সাহিত্য, অথচ ভিতরে থেকে গেল আরও কয়েকটি স্তর। যে স্তরগুলো শিশুবেলা অতিক্রম করেও অমলিন। বিভিন্ন বয়সের পালতোলা নৌকাযাত্রা। সুকুমার আর রবীন্দ্রনাথের হাতেই যেন ‘সময়’ নতুন একটা ধারণা পেল। তৈরি হয়ে গেল বাঙালির শিশু সাহিত্যের ভিন্ন এক ভুবন। অসম্ভব ভাললাগার মনটি শৈশব উত্তীর্ণ করলেও বেরোতে পারল না সুকুমার, রবীন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজনের সময়োত্তীর্ণ সাহিত্য থেকে। শুরু হয়ে গেল নীতিশিক্ষা ও রূপকথার বাইরে দাঁড়িয়ে টাইম ও স্পেসের অসম্ভব এক সাহিত্যজাত ধারণা। বাঙালির শিশু সাহিত্য যথার্থ অর্থেই হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক। এ সংখ্যায় সেই সময়টিকেই ধরতে চাওয়া হয়েছে বিষয়গতভাবে এবং শিশু–সাহিত্যের মুখ্য ও গৌণ লেখকদের কর্মজগতকেও ধরা হল বিভিন্ন রচনায়। এমন একটি বিষয়ে চোখ রাখতেই নজরে এল আশ্চর্য একটি ঘটনা। ১৯৩৬–এ ‘অজানার উজানে’ নামক একটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসটির জন্ম–ইতহাস অভিনব। এ প্রসঙ্গে খগেন্দ্রনাথ মিত্র তার গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘এরূপ উপন্যাস পূর্বে ও পরেও বাংলার শিশু–সাহিত্যে আর রচিত ও প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। উপন্যাসখানি দ্বাদশজন লেকক রচনা করেন…।’ ‘অজানার উজানে’ উপন্যাসটি ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টচার্য সম্পাদিত ‘মাসপয়লা’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। রচনাটি শুরু করেছিলেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শেষ করেন ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য। বারোজনের মধ্যে আর দশ জন হলেন, শোভনলালা গঙ্গোপাধ্যায়, যতীন সাহা, সুনির্মল বসু, অখিল নিয়োগী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবিনয় রায়চৌধুরী ও খগেন্দ্রনাথ মিত্র।
উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সময়ে। বাংলা সাহিত্যেই বোধহয় এমন উল্লেখযোগ্য ঘটেছে যে, বারোজন শিশু–সাহিত্যিক মিলে ধারাবাহিক একটি প্রয়াস সেই সময় সুচিত করেছিলেন। পরে আর তেমন কোন যৌথ বা সমবেত প্রয়াসের খবর তৈরি হয়নি।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে পরীক্ষামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ শিশু–সাহিত্যে দেখা গিয়েছিল। শিশুদের পত্র–পত্রিকায় ছবির জগতেও বিভিন্ন নিরীক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়।
শিশু–সাহিত্য রচয়িতারা তেমনভাবে তবু স্বীকৃতি পাননি, ব্যতিক্রমী দু–এক জন ছাড়া। শিশু–বেলা ফুরিয়ে গেলে শিশু–সাহিত্যিকও যেন দূরে চলে যান, থেকে যান বিশেষ একটি সময়ের রচয়িতা হিসেবে। অথচ আপামর বাঙালির শৈশবে এ সমস্ত রচনাই স্ফুলিঙ্গের মতো ভূমিকা গ্রহণ করে চিন্তাজগৎ নির্মাণে। তবুও তাঁরা স্বীকৃতিহীন অথচ শিশু–সাহিত্যের প্রসঙ্গ বা লোকমুখে প্রচারিত ছড়ার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অভিনব মন্তব্য করেছেন। তিনি ছড়াকে মেঘের সঙ্গে তুলনা করে ‘ছেলেভুলানো ছড়া’য় লিখেছিলেন, ‘আমি ছড়াকে মেঘের সঙ্গে তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছা ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচারে শাস্ত্রের বাহির, মেঘবিজ্ঞানও শাস্ত্রনিয়মের মধ্যে ভালো করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড়জগতে এবং মানবজগতে এ দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে। মেঘে বারিধারায় নামিয়া আসিয়া শিশু–শস্যকে প্রাণদান করিতেছে এবং ছড়াগুলোও স্নেহরসে বিগলিত হইয়া কল্পনাবৃষ্টিতে মিশু–হৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলিতেছে।’
Our facebook page