Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
সাইদ রহমান
’তেতো সত্য’ বলার জন্য হুমায়ুন আজাদ একমেবাদ্বিতীয়ম। শুনতে খারাপ লাগলেও বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা নিয়ে সত্যের সবেচেয়ে কাছাকাছি বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা স্থূল মানুষ, তারা সৌন্দর্য বোঝে না বলে গণতন্ত্রও বোঝে না; শুধু লাইসেন্স-পারমিট আর মন্ত্রিগিরি বোঝে।’
অথবা এই উক্তিটি, ‘এখন পিতামাতারা গৌরব বোধ করেন যে তাদের পুত্র গুণ্ডা। বাসায় একটি নিজস্ব গুণ্ডা থাকায় প্রতিবেশীরা তাদের সালাম দেয়, মুদিদোকানদার খুশি হয়ে বাকি দেয়, বাসার মেয়েরা নির্ভয়ে একলা পথে বেরোতে পারে এবং বাসায় একটি মন্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’ হুমায়ুন আজাদের কথা গড়পড়তা শোনা গেলেও অন্তত অধিকাংশের চরিত্র বিচার করলে সত্যটা এরচেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কথা নয়।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগে ‘কাউয়া’ এবং ‘দোকানদারি’ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার বক্তব্য দিয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ যেমন প্রথাবিরোধী লেখক, এখানে ওবায়দুল কাদেরও তেমনি প্রথাবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা প্রথা নয় যে, দলের মধ্যে থেকে কেউ দলের সমালোচনা করবে।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে সিলেট আসার পথে বিলবোর্ডে অনেক ছবি, অনেক সৌজন্য পোস্টার দেখলাম। কিন্তু আজকে রাজনীতিতে সৌজন্যতা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা আমরা বলি অথচ অনেক জায়গায় দেখেছি গত বিজয় দিবসের, গত ঈদের বিলবোর্ড এখনো রাস্তায় টানিয়ে রেখেছেন। এতে বঙ্গবন্ধুর, শেখ হাসিনার ছবি মলিন হয়ে গেছে।
এসব ছবি দেখে আপনাদের কি লজ্জা করে না?’ তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগে ‘কাউয়া’ ঢুকেছে। রাজনীতির নামে অনেকেই দোকান খুলে বসেছেন। আওয়ামী লীগে দোকানদারি চলবে না। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’
আরও একটি প্রশ্ন তিনি তুলেছেন যেটি ইতোপূর্বে কেউ তোলেনি, অন্তত কোনো রাজনীতিক তোলেননি কারণ, তাতে তাদের রাজনৈতিক দোকানদারিতে বেচাকেনা কমে যেতে পারে। প্রশ্নটি হল, ‘জাতীয় শ্রমিক লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার কী দরকার? বিদেশে শ্রমিক লীগের দরকারটা কী? কৃষক লীগের গুলশান শাখার কী দরকার? অথবা ধানমন্ডিতে?
ধানমন্ডিতে যে ধান চাষ হয় তা তো আমি জানি না। কৃষক লীগের কাতার শাখার কী দরকার? তাঁতী লীগ নাম দেখলাম কুয়েতে, না কাতারে। তার আবার পাল্টা দুই কমিটি!’ এভাবে আরও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ছাত্রলীগের কমিটির কী দরকার?
কে না জানে, রাজনীতিটা এদেশে একমাত্র ‘পুঁজিবিহীন ব্যবসা’। কোনো অ্যাডভান্স লাগে না, ভাড়া নেই। ডেকোরেশনের খরচ নেই। টাকা খাটিয়ে মালামাল তোলারও কোনো ব্যাপার নেই। শুধু মনুষ্য বৈশিষ্ট্য থেকে একটু নিচে নামতে হবে। তৈলমর্দন জানতে হবে। সভ্যতা, ভব্যতা, যুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পেশীশক্তির ব্যবহার করতে হবে। ব্যাস, আপনার রাজনীতিক হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
‘এসব কথাবার্তা দেশকে বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র’ এমন কথা বলে যারা প্রায়শই গর্জে ওঠেন, তাদেরকে বলি, আপনার চিৎকারে সত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় না। অল্প কয়েকজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছাড়া ব্যবসাটা ভালো হচ্ছে বলেই সবাই রাজনীতিতে জড়িয়ে আছে, মহৎ কোনো আদর্শের জন্য নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এদেশে বর্তমানে একজন রাজনীতিক হওয়ার প্রক্রিয়াটা কি? এই প্রক্রিয়াকে যদি একটা ‘চুঙ্গা’ হিসেবে কল্পনা করি তাহলে সেই চুঙ্গা এতটাই কদর্য যে, তার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে নিজের মনুষ্যত্ব বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
যদি ছাত্রসংগঠনকে প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ ধরি তাহলে বলতে হয়, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যেহেতু ছাত্র সংসদ নেই তাই শিক্ষার্থীর স্বার্থের জন্য আন্দোলন করে কিংবা সর্বোপরি আদর্শিক রাজনীতি করে জনপ্রিয়তা যাচাই করার কোনো ব্যাপার নেই। তাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ফাও খাওয়াই হয়ে ওঠে ছাত্রনেতার মূল কাজ। ধরি, কোনো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিল এবং শুরুতেই বড় ভাইয়ের ‘ফাও খাওয়ার’ প্রতিবাদ করলো তাহলে কি তার রাজনীতি শুরু করা হবে নাকি ঠ্যাং ভাঙ্গা যাবে?
আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথায় ফিরে আসি। তিনি ঘরের মধ্যে ঘর বানানো এবং মশারির ভেতর মশারি টানানোর সমালোচনা করেছেন। এই সমস্যা শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতে আছে, আছে অন্যান্য দলগুলোতেও। পার্থক্য শুধু এইটুকু, যেখানে ব্যবসা যত ভালো সেখানে দোকান তত বেশি। ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপিতে এখন দোকান কম হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দোকানগুলোর নাম হয় ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘লীগ’ এই শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ব্যবহার করা হয় ‘জাতীয়তাবাদী’ এবং ‘জিয়া’ শব্দ দুটি।
তিনি অভিযোগ করেছেন, তার দলে ‘কাউয়া’ ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ‘কাউয়া’ আগমনের কার্যকারণ বলেননি। অর্থাৎ কাউয়াগুলোকে কারা ভাত-মুড়ি ছিটিয়ে প্রলোভণ দেখিয়ে এনেছে? শীর্ষ রাজনীতিবিদদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কাউয়া এলো কিভাবে? তারা হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির চিরায়ত নিয়মে অস্বীকার করে বসতে পারেন, ‘আমরা ভাত ছিটাইনি!’ তাহলে কি রাজনীতিবিদদের শারীরিক এবং মানসিক দুর্বলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের নিজেদের ঘরে কাউয়া ঢুকে খেয়ে-দেয়ে মাখিয়ে-মুখিয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার করছে কিন্তু তারা মুখে অন্তত ‘হুস’ বলতে পারছেন না!
সত্যটা হল, ‘কাউয়া’ নিজে থেকে দলে প্রবেশ করে না। শীর্ষ রাজনীতিবিদদের ‘ব্যবসায়িক চ্যালা’ হিসেবেই এরা দলে থাকছে। ব্যবসাটা যখন পুঁজিহীন তখন এখানে ভিড়-ভাট্টা থাকবে, দলাদলি থাকবে। তাই সবাইকে সাথে নিয়ে ভাগাভাগি করেই ব্যবসাটা চালিয়ে নিতে হয়। এই সত্যটা ওবায়দুল কাদেরও জানেন কারন তিনি বাংলাদেশে রাজনীতি করেন।
গুরুত্ব না থাকলে নেতারা কেন যান এসব সভা-সেমিনারে? সহজ জবাব, ‘রাজনৈতিক ব্যবসাটা’ টিকিয়ে রাখতে হলে একটু প্রচার-প্রসারের দরকার হয়। ওদিকে ‘খরচ’ তোলার কথা বলে টাকার একটা অঙ্ক ঢুকে আয়োজকদের পকেটে। আবার গণমাধ্যমে নিজেদের ছবি প্রকাশ হলে নামটাও ফোটে। আর এটা ভাঙিয়ে ‘করে খান’ কেউ কেউ। এমন সামষ্টিক সুবিধার পেটনীতিটাই আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি।
জলের সাথে লবন যেমন দ্রবীভূত হয়ে একাকার হয়ে যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতেও স্বার্থটা এমন একাকার হয়ে আছে। তাই আলাদা করে কাউকে ‘কাউয়া’ কিংবা দোকানদার বলার সুযোগ কম। যার নাম নিয়ে এই দেশে আয়োজন করে থুতু ফেলার কথা শুনেছি সেই ‘বড় কাউয়া’ এখন দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর বিশেষ দূত! যে ক্যাম্পাসে রাউফুন বসুনিয়ার রক্ত ঝরেছে সেই ক্যাম্পাসে এই বিশেষ দূতের জন্মদিনও পালন করা হয়। সর্বোপরি এদেশে এখন ‘রাজনীতিটাই দোকানদারি’ অথবা ‘দোকানদারিটাই রাজনীতি’।
‘জনগনের কল্যাণের জন্য রাজনীতি’ এই আপ্তবাক্য এখন জাদুঘরেও নেই। নেতাতোষণ আর নেতাস্তুতিও আছে। বাস্তুসংস্থানের নিয়ম মেনে ছোট নেতা তার নিকটতম বড় নেতার স্তুতি করে। ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে শেয়াল পড়লে বাঁচার জন্য ঐ শেয়াল যে পরিমাণে বাঘের স্তুতি করবে ঠিক সে পরিমাণ অথবা তার চাইতেও বেশি। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সেই সব স্তুতি বাক্য শুনে একজন সভ্য পথচারীও ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যান কিন্তু পাশে বসে থাকা নেতা কুঁকড়ান না।
এই সুযোগে যে যত বড় আকারের পারছে, তেলের বাটি উপুড় করে দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে কোনো এক জেলা শহরের রাস্তায় একটি পোস্টার চোখে পড়ছিল। সেখানে লেখা ‘নুহ নবীর নৌকা একবার মানব জাতিকে উদ্ধার করেছিল এবার মানবজাতিকে উদ্ধার করবে শেখ হাসিনার নৌকা।’
‘যারা খাউয়া-তারাই কাউয়া।’ সত্যিকারের কাউয়ার মতো এরা বাছ-বিচারহীনভাবে সব খায়। ভিজিএফ কার্ডও খায় আবার নদীর বালুও খায়। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা খায়, টেন্ডারও খায়। অনেকটা ‘ওলট পালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ এর মতোন। যে যেভাবে পারে, লুটপাট করছে, যতটুকু কুলাচ্ছে, খাচ্ছে এবং সংগ্রহ করছে। মালয়েশিয়াতে থাকে এদের ‘সেকেন্ড হোম’ আর টরেন্টোতে থাকে ‘বেগমপাড়া’। থার্ড হোমও থাকতে পারে, হয়তো এখনও আবিস্কার হয়নি।
অবশ্য এই রাজনৈতিক দোকানদারির সবটা জুড়েই ক্ষমতাসীন দল। আপনি ক্ষমতায় আছেন, সব কিছু আপনার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে। টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, টেন্ডার বাক্স, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-প্রশাসন সব কিছু। আপনি বিরোধী দলে থাকবেন, আপনার কিছু নেই। ব্যবসা করতে যাবেন, আপনাকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে না। আপনি টেন্ডারে নিয়মনীতি মেনে অংশ নেবেন- আপনার টেন্ডার বাতিল হয়ে যাবে।
আপনার গুম হওয়ার আশঙ্কা আছে, গুম না হলে অন্তত নিয়মিত কারাগারে যেতে হবে। এসব দুর্যোগ এড়াতে হলে অন্য একটি উপায় আছে। তা হল এস্কিমোদের (উত্তর আমেরিকার একটি নৃগোষ্ঠি যারা বৈরি আবহাওয়ার দীর্ঘ সময় গর্তে বসবাস করে) মতো জীবন। এস্কিমোরা যেমন বরফ ঝড়ের আগে খাদ্য, পানীয় এবং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে গর্তে ঢুকে বৈরী আবহাওয়া পর্যন্ত মজুদ খাবার দিয়েই জীবন চালিয়ে নেয়, তেমনি যখন আপনি সরকারে থাকবেন, বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যাবেন এবং বিরোধি দলে গেলে এস্কিমোদের মতো গর্তে ঢুকে (দেশ ত্যাগ করে) মজুদ খাবার খাবেন। এভাবে আপনাকে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিতে হবে।
এই হল আমাদের ‘যাত্রাপালার’ রাজনীতি। জনগণ এখানে মন্দের ভালো খুঁজতে গিয়ে পিংপং বলের মতো একবার এই কোর্টে তো অন্যবার ঐ কোর্টে অবস্থান নেয়।
সাংবাদিক, কলামিস্ট
sayd.rahman @yahoo.com
Our facebook page