Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর আসে আর আমার বুকটা ভেঙে যায়। আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন এই ৩ ডিসেম্বর। আমি যদি এই ৩ ডিসেম্বরটা ভুলে থাকতে পারতাম। ২০০৮ সালের এই দিন আমি আমার মাকে হারিয়েছি। জীবনে যতোদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন প্রতি বছরের এই ৩ ডিসেম্বর আমার জীবনের শোকের দিন হয়ে থাকবে। প্রতি বছরের এই দিনে আমি কষ্টের স্মৃতিচারণ করি। আজও করছি।
আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার মা নেই। মনে হয়, ঢাকা ছেড়ে বাসায় গেলেই বোধহয় মা ছুটে আসবে। ব্যঙস্ত হয়ে পড়বে আমাকে নিয়ে। মানতে ইচ্ছে করে না, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তবুও এটাই সত্যি যে এমনটি আর হবে না আমার এ জীবনে। আর কখনোই আমার মা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না। ৩ ডিসেম্বরের আগে আমি আমার জীবনে হারানোর বেদনা কখনো বুঝিনি। আর ৩ ডিসেম্বরের পর গত নয় বছরে আমি শুধু হারানোর বেদনা নিয়েই বেঁচে আছি।
২০০৮ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তায়, কোরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে আমরা মাকে স্বাভাবিক চেকআপের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করি। সুস্থ্য একজন মানুষ, উচ্চ রক্তচাপের কারনে হাসপাতালে। আমরা কেউই বুঝতেই পারিনি এভাবে হুট করে মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। হাসপাতালে তিনদিন সবই ভালো। কিন্তু ১ ডিসেম্বর কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ আইসিইউতে নিতে হয়। দুদিন সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইসিইউতে থাকার পর আমার মা চলে গেলেন আমাদের চোখের জলে ভাসিয়ে, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে।
আমার মা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তার হয়নি বিয়ের কারনে। কিন্তু আমার মনে হতো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও বোধহয় মায়ের মতো মানুষ হতে পারেনি। আমার মা ক্লাসের সেকেণ্ড ছিলেন। প্রথম যে ছিলেন তিনি ডাক্তার। সেই জাহাঙ্গীর মামাসহ অনেকের কাছে শুনেছি ছোটবেলা থেকে, তোরা ভাইবোনরা লেখাপড়ায় ভালো, কারণ তোর মা ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিলেন।
আমার মায়ের মনটা ছিলো বিশাল। চট্টগ্রামে আমার বাবার সরকারী চাকুরি ছিল। সরকারী কলোনীতে আমরা যে বাসায় থাকতাম সেখানে একবার যে গেছে সে মায়ের রান্না খেয়ে, তার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। মা মানুষকে খাইয়ে খুব আনন্দ পেতেন। সবসময় তিনি বাসায় মেহমান খুব পছন্দ করতেন। দিন নেই, রাত নেই বাসায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে যেতাম। মা কখনো বিরক্ত হয়ে বলতেন না অসময়ে কেন এতো বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসিস?
আমার মায়ের মতো অসাম্প্রদায়িক মানুষ, উচ্চ মনের মানুষও আমি কম দেখেছি। নিজে নামায পড়তেন, কিন্তু বাসায় যারা আসতো হিন্দু বৌদ্ধ কোনদিন কাউকে খাওয়াতে মাকে কার্পন্য করতে দেখিনি। শুধু জানতে চাইতেন কে কী খাবে। আর গরীব বা ভিক্ষুকদের মা কখনো না বলতেন না। ছোটবেলায় অামরা তিন ভাইবোন প্রতিযোগিতা করে ভিক্ষা দিতাম কে কার চেয়ে বেশি চাল দেবো। অামার মা কখনোই বকতেন না অামাদের।
কলোনীতে থাকার কারনেই বাসায় সবসময় ভিক্ষুক আসতো। ঢাকা থেকে গিয়ে আমি মাঝে মধ্যে টানা তাদের কলিং বেল শুনে বিরক্ত হতাম। বিশেষ করে ঢাকায় এসে সুস্থ ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দিতে চাইতাম না। চট্টগ্রামে গিয়ে একইভাবে সুস্থ ভিক্ষুকদের চলে যেতে বললে তারা অামাকে উল্টো জিজ্ঞাসা করতো, অাপনি কেন? এই বাসার খালাম্মা কখনো না করে না জানেন না?
অামি তখন লজ্জা পেতাম। মাঝে মাঝে এ নিয়ে মায়ের সাথে মজা করে বলতাম, মা ভিক্ষকু-গরিব এরা কি তোমার বান্ধবী? সবসময় এতো জ্বালাতন করে কেন? মা হাসতো। মা মাঝে মধ্যে টাকা চাইতেন। আমি বলতাম মা কি করবে? তিনি হাসতেন। সেই টাকা চলে যেতো গরীবদের বা তাদের শিশুদের কাছে। তাঁর জীবনে এমন দিন খুব কমই গেছে যেদিন তিনি কোন গরিব বা অসহায় মানুষকে খাওয়াননি।
মানুষের জন্য মায়ের ছিলো চরম সহমর্মিতা। কারো কোন কষ্টের কথা শুনলেই মা কাঁদতেন। তাদের স্বান্ত্বনা দিতেন। এমন মানবিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। মা মারা যাওয়ার পর আমার ছোট বোন জানালো, কয়েকদিন আগে নাকি সকাল ১১ টার দিকে এক গরিব মানুষ আমাদের বাসায় এসে মাকে বললো তার খুব খিদে লেগেছে। ১১ টার সময় রান্না থাকার কথা নয়, তাই বাসায় ভাত নেই। কিন্তু আমার মা গরম ভাত রান্না করে তাকে খাইয়ে বিদায় করলেন। এমন হাজারো ঘটনা আছে আমার মায়ের জীবনে।
গল্প করলে শেষ হবে না। আমার মা কে আমার এখন গল্প উপন্যাসের চরিত্র মনে হয়। কখনো খুব বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে আমাদের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতেন। আমাদের পাগলামিকে সমর্থন দিতেন। মানুষের পাশে থাকতে বলতেন। প্রতিবেলা রান্নার আগে মা পুরনো ভাত বাইরে কাক বা শালিককে দিতেন। মার রান্না করার সময় রান্নাঘরের সামনে সবসময় পাখি থাকতো। মা প্রচুর বই পড়তেন। তাঁর কারনেই ছোটবেলা থেকে আমরা ভাই বোন প্রচুর গল্পের বই পড়তাম। অন্যরা গল্পের বই পড়লে নাকি তাদের বাবা মা মকা দেয়। অামার মা অামাদের উৎসাহ দিতেন। সবসময় ভালো মানুষ হতে বলতেন, মানুষের জন্য করতে বলতেন।
আমাদের তিন ভাইবোনের সব বন্ধুদের আম্মা নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। তাই তিনটা ব্যাচেরই আড্ডা খাওয়া বেড়ানোর জায়গা ছিলো আমাদের বাসা। গভীর রাত কিংবা দুপুর কতো সময় যে হুট করে কতো বন্ধুদের নিয়ে আমি বাসায় গেছি। আম্মা শুধু বলতেন একটু আগে থেকে বলে আনলে ভালো হতো। একটু খাওয়ানো যেতো ভালো করে।
আমাদের পরিবারে দুঃখ কষ্ট সেভাবে ছিল না। বেশিরভাগ সময়েই ছিল আনন্দ উচ্ছলতা। কিন্তু এতো আনন্দের মধ্যেই আমার মা চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। ভাসিয়ে দিয়ে গেল অামাদের দুঃখের সাগরে। আমরা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি সে এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবে।
৩ ডিসেম্বর সকাল সোয়া সাতটায় আমার মা মারা যায়। ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে আমার ছোটবোনটার কান্না দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। আমি সেই কান্না আজও ভুলতে পারিনা। আমরা দুই ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারনে খুব কম বাসায় থাকতাম। ছোট বোনটাই বাসায় বেশি থাকতো। ওর কতো আফসোস মাকে নিয়ে। ও হাসপাতালে মাকে সুস্থ্য দেখে, রাতে খাইয়ে বাবার সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিল ভর্তি হতে। এসে দেখে মা আর নেই।
এসএসসি পাস করার পর অামি বাসা ছেড়ে কলেজ হোস্টেল, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলেয়ের হল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেশা আবার সাংবাদিকতা। তাই বছরের খুব কম সময় বাসায় গিয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু যখন যেতাম মা আমায় নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে উঠতেন। কি খাওয়াবেন কি করবেন দিশা পেতেন না। আমি ফেরার সময় মায়ের চোখ ছলছল করতো। ভাবতে কষ্ট হয়, সেসব দিন আর কখনো ফিরে আসবে না। ভাবতে কষ্ট হয় আমার জীবনে নানা ধরনের দিন আসবে কিন্তু কখনো মাকে আর পাবো না।
গত আটটা বছর ধরে প্রায় প্রতিনিয়ত আমি মা হারানোর যন্ত্রণা টের পাই। মায়ের কবরে গেলে অামার তীব্র কান্না পায়। জানি আমার মা জান্নাতেই আছে। মাকে খুব ভালোবাসি। ঙআজও প্রচণ্ড মন খারাপ হলে আমার খুব চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করে মা…।
(শরীফুল হাসনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)
Our facebook page