Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
কালে ফেসবুকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মউ আর নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঘটনা সত্যি। মউ আর নেই। গণমাধ্যমের সংবাদে আরও নিশ্চিত হলাম। মনটা বিষাদে ভরে গেল।
মউ চট্টগ্রামের ভাষা। মানে মামা। সাধারণত দোকানদারদের মামা বলে ডাকার একটা রেওয়াজ আছে আমাদের সমাজে। ওই মউও একজন দোকানদার। মূল নাম, গুরা মিয়া সওদাগর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চা আর সমুচার দোকান নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি। সব শিক্ষার্থীরা মামা। কালের বিবর্তনে ভাষার তাগিদে মামা হয়ে উঠলেন মউ। এ শব্দে যেন হাজার ভালবাসা, শ্রদ্ধা। তা বুঝতে পারলেন তিনি। দোকানের উপড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে সেই ভালবাসার স্বীকৃতি দিলেন, ‘মউর দোয়ান।’ শুদ্ধ বাংলায় মামার দোকান।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, এ দোকানে খাওয়ার। মউর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার। বেশ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। ছোট ভাই ও সাংবাদিক সুজন ঘোষের মাধ্যমে ওই দোকানে যাওয়া, মউর সঙ্গে পরিচয় হওয়া। সাদা দাড়ি আর চুল বয়সটা বলে দিচ্ছে। কিন্তু যখন কথা বলা শুরু করলেন, তখন মনে হলো এ মউ চির তরুণ, চির সবুজ, দীপ্তময়, ভালবাসাময়।
মউয়ের কথায় মজে গেলাম। তিনি এত আন্তরিক হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন যেন আমি তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত। তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ব্যবসা শুরুর কথা, বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীদের কথা যারা তাঁর দোকানে এখনও আসেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা, তাঁর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধার কথা। তিনি বললেন, অনেক জায়গায় তাঁর ব্যবসা করার সুযোগ ছিল। নেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, শিক্ষার্থীদের ভালবাসা তাঁকে অন্য কোথাও যেতে দেয়নি। জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত তিনি কাটিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দশ পনের মিনিটে আমাদের চা নাস্তা খাওয়া শেষ। কিন্তু দোকানে ছিলাম এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। আমার কেন জানি, মউয়ের কথাগুলো ভাল লাগছিল। আমি অতীত জীবনে প্রথম পরিচয়ে এমন আন্তরিক মানুষ পাইনি। আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলাম। শতবার মউ, মউ বলছিলাম। আর দেখছিলাম, তাঁর মুখে অকৃত্রিম স্বর্গীয় হাসির আভা। আমি অনুভব করলাম, মউ ডাকার মধ্যে কী এক মমতা খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। আমার চায়ের পর চা চলতে থাকল, আমি বিভোর হয়ে শুনছিলাম মউয়ের কথা।আমিও অনুভব করলাম, আমার মধ্যেও এক অদ্ভূত ভাল লাগা কাজ করছিল। একজন দোকানদার কত বড় মনের মানুষ হলে তার চোখে মুখে নিঃস্বার্থ ভালবাসা ফুটে ওঠে।
বিদায় নেওয়ার সময় খাবারের বিল দিতে যাবো, তখনই বললেন, ‘মউ ডাইক্যুন। ভাইনুত্তুন টিয়া লইয়্যুম কে নে? আবার আইস্যুন।’ মানে, মামা ডাকছেন। ভাগ্নের কাছ থেকে টাকা নেবো কীভাবে? আবার আসবেন।’ জোর করেও আমি বিল দিতে পারিনি। এরপর অনেকদিন মউর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ফোন করলেই, ‘বাজি, ক্যান আছন?’ মানে ‘বাবা, কেমন আছেন?’ বলে যেভাবে সম্বোধন করতেন, তাতে আমার অদ্ভূত ভাল লাগত। আমাকে তাঁর দোকানে যেতে বলতেন। আমি যাবো বলতাম। অনেকদিন পরিকল্পনাও করেছি। কিন্তু সময় আর সুযোগের অভাবে আর যাওয়া হয়নি। এখন গেলেও আর লাভ নেই। মউ নেই। চলে গেছেন শুক্রবার, পৃথিবী ছেড়ে।
ফেসবুকে আর গণমাধ্যমে তাঁর মৃত্যুতে শোক গাঁথা দেখে বোঝাই যায়, এ মানুষটিকে কত মানুষ ভালবেসছেন। এ ভালবাসার কৃতিত্ব আবার তিনি নিজেই। কারণ, তিনি সবাইকে ভালবেসেছেন, ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজের ছেলেমেয়ের মতোই স্নেহ দিয়েছেন। আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়িনি। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আপন মনে হওয়ার যদি কয়েকটি কারণ লেখা হয়, তার সর্বাগ্রে থাকবেন মউ। আমি নিশ্চিত, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকের মাঝে আপন করে নেওয়ার কাজটি পরোক্ষভাবে অগোচরে করে গেছেন এ মানুষটি। জানি না, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীরা এ মানুষটির স্মৃতি রক্ষার্থে কী করবেন। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন অনেকের মাঝে, চির তরুণ, চির সবুজ, ভালবাসার প্রতীক হয়ে।
প্রিয় মউ, মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার মত্যুকে আমি কেন জানি মেনে নিতে পারছি না। সারাজীবন আপনি মানুষকে ভালবেসেছেন, ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষে মানুষে সুন্দর এক সম্প্রীতি আর একতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন আপনি আপনার ওই নড়বড়ে দোকানে, চা-সমুচা বিক্রির আড়ালে। তাই আপনার মৃত্যুতে মনের মধ্যে চলা বেদনা বেড়ে গেল। পৃথিবীতে চলছে মানবতার মহাবিপর্যয়। মানুষ মেতেছে মানুষ হত্যার মহোৎসবে। পানিতে ভাসমান হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশুর নিষ্পাপ মৃত মুখ দেখছি। রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত মানুষ দেখছি। দেখছি, রক্তাক্ত মা শুয়ে আছেন, তার বুকে রক্তাক্ত শিশু, নিথর, নিস্তব্ধ। দেখছি, চোখের জল, কষ্টের নিদারুণতা। দেখছি, অসহায় মানুষের নিদারুণ পৃথিবী। দেখছি, একদল হায়েনার ভয়ংকর মুখ। মানুষরূপী হিংস্র পশুর ভয়ংকর থাবা।
প্রিয় মউ, মনে হচ্ছে, মানবতার এই চরম অপমানে পৃথিবীকে লাথি দিয়ে চলে গেছেন আপনি।
প্রিয় মউ, ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে, আপনার চলে যাওয়া সামনের দিনগুলোতে পৃথিবীতে ধেয়ে আসা চিরস্থায়ী অমানবিক ঘোর অন্ধকারের এক অশনি সংকেত।
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
তত্ত্বাবধায়ক, নতুন কিছু ডট কম
সম্পাদক, রাইজিং নিউজ ২৪ ডট কম
Our facebook page