Latest News
ফেনীতে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে শিক্ষার্থী নিহত
মে ১৯, ২০২৪
বান্দরবানে বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
মে ১৯, ২০২৪
গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ৪
মে ১৯, ২০২৪
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
নাটক যেহেতু জীবনকে বৃহত্তর অর্থে ধারণ করে, তাই এই শিল্পের জন্য একটি বৈশিষ্ট্যময় ভাষা নির্মাণ প্রয়োজন। এই ভাষায় কখনো ‘প্রমিত’, কখনো ‘আঞ্চলিক’, আবার ‘দুইয়ের মিশ্রণে’ এক নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। এখানেই নাট্যকারের বড় ধরনের কৌশল কাজ করে। নাটকের চরিত্রগুলো যেমন ভিন্ন, ভিন্ন যেমন তাদের জীবনবোধ, তেমনি আচার-আচরণও বহুমাত্রিক। স্থান, কাল ও পাত্র বিবেচনায় একই গ্রন্থিতে নাটকটিকে সাজাতে গিয়ে নাট্যভাষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষায় অক্ষর দিয়ে যখন শব্দ নির্মিত হয়, তার মধ্যেই চিত্রকল্পের আভাস আমরা পেয়ে থাকি। বাংলা ভাষার যথাযথ শব্দও আছে প্রচুর। শব্দচয়নে কবির মতো নাট্যকারকেও চরিত্র অনুযায়ী শব্দ চয়ন করতে হয়। নাটক যেহেতু জীবনের সারাৎসার, তাই সংলাপ নির্মাণের ক্ষেত্রে ভাষা আমাদের যে সুযোগ করে দিয়েছে তার যথার্থ প্রয়োগ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যকে যে মহাকাব্যিক স্তরে নিয়ে গেছেন তার একটা প্রধান কারণ যথার্থ শব্দ ও ছন্দের ব্যবহার। এই ব্যবহারবিধি কাব্যের চরিত্রগুলোকে অভূতপূর্ব নাটকীয়তা দিয়েছে। কোনো কষ্টকল্পনা নয়, দুরূহ শব্দ চয়ন নয়, অবলীলায় তিনি শব্দমালা সাজিয়েছেন এবং ছত্রে ছত্রে দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন। একই লেখক যখন প্রহসন লেখেন, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। আঞ্চলিক ভাষার মধ্য থেকেও তিনি চমৎকার অভিনব নাট্যভাষা নির্মাণ করা যে সম্ভব, তা-ও প্রমাণ করলেন। এ কারণেই বোধ হয় তিনি বলেছেন, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন। ’
পূর্ব বাংলার নাট্যকাররা যেমন প্রমিত বাংলায় সংলাপ নির্মাণ করেছেন, তেমনি আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্য অনুধাবন করে অসাধারণ সব নাটক রচনা করেছেন। পূর্ব বাংলা যেহেতু কৃষিপ্রধান, প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক দৈনন্দিনের, তাই তার কথকতা, জীবনযাপন, জীবনসংগ্রাম সব যেমন জীবন্ত, তেমনি রহস্যময়। মারি-মড়ক-ঝড়-ঝঞ্ঝা, নদীভাঙন—এসবই যেমন তার নিত্যসঙ্গী, তেমনি পলিমাটিতে যখন ফসলের বান ডাকে, কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবে নতুন জীবন জেগে ওঠে। বঞ্চিত কৃষকের যেমন আছে হাহাকার, তেমনি আছে বিদ্রোহ। তাই এ অঞ্চল অসংখ্য কৃষক আন্দোলনের জন্মভূমি। এসব মানুষের অন্তরের গভীরের ভাষা কেমন হতে পারে? তার জবাব মেলে আমাদের কাব্যে, গানে, আখ্যানে, গল্প বলায় ও আঞ্চলিক লোককাহিনিগুলোতে। যুগ যুগ ধরে অজানা কবিয়াল, অভিনেতা, পালাকারদের মুখে মুখে রচনায় এসব উঠে এসেছে এবং আমাদের ভাষা নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। একদিকে বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে প্রমিত বাংলার সমৃদ্ধি, অন্যদিকে লোকশিল্পীদের বয়ানে আঞ্চলিক ভাষাও তার উত্তরণের পথ বেছে নিয়েছে। এই দুইয়ের অহর্নিশ মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ভাষার সমৃদ্ধি। নাটকের রচয়িতাকেও এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে, আবিষ্কার করতে হবে তার যথার্থ নাট্যভাষা। এই বিষয়গুলো গভীরভাবে অনুধাবন করতে গিয়ে নাট্যকাররা আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তুলসী লাহিড়ী, বিজন ভট্টাচার্য, মনোজ মিত্র, সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মান্নান হীরা, আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ এবং আমি নিজেও আঞ্চলিক ভাষার আশ্রয়ে নিজ নিজ নাট্যভাষায় জীবনের গভীরকে খনন করার চেষ্টা করেছি।
সেই খনন বৃথা যায়নি। তাঁদের লেখা অনেক নাটক বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে বহুবার মূল্যায়িত হবে। বাংলাদেশের নাটক দেখতে পশ্চিমবঙ্গের দর্শকরা ব্যাকুল হয়ে ওঠে, এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, আপনাদের ভাষা ও সংলাপ প্রক্ষেপণের শক্তি দেখে আমরা অবাক হই। সুদীর্ঘ দিনের নাগরিক জীবনযাপন, সাহিত্যচর্চা, নাট্যাভিনয়ের ওপরও প্রভাব পড়েছে। সংগত কারণেই তাদের হৃদয়ের দুয়ার অর্গলবদ্ধ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের, অতীতের পূর্ব বাংলার পার্থক্য দৃশ্যমান। নির্বোধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৮ সালে আমাদের ভাষার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শত শত বর্ষের জনগণের নির্মিত জলবায়ু ও প্রকৃতি, নদীনালা, সাগর-মেঘমালার মধ্য থেকে উৎসারিত বাংলা ভাষাকে কোনো রাজন্যের পক্ষে সরকারি নির্দেশে কি বন্ধ করা সম্ভব? সেই অসম্ভবের পায়ে ধূলিসাৎ হয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। কবি কাব্য রচনা করেছেন, গায়ক গান গেয়েছেন, নাট্যকার তাঁর আপন নাট্যভাষায় সংলাপ লিখেছেন, রাজনীতিক তাঁর প্রতিবাদী ভাষায় ফুলকি রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় যে প্রতিবাদের অগ্নিক্ষরণ হয়েছে তা ইতিহাসের এক সম্পদ। সবাই নাট্যভাষায় মনোলগ রচনা করেছেন। সেই মনোলগের পথ ধরে উত্তাল গণ-আন্দোলন হয়েছে, আহ্বান করেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। তাইতো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল ফসল ফলেছে নাটকের ক্ষেত্রে, যার নাট্যভাষা বাংলা।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব
Our facebook page