Latest News
ফেনীতে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে শিক্ষার্থী নিহত
মে ১৯, ২০২৪
বান্দরবানে বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
মে ১৯, ২০২৪
গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ৪
মে ১৯, ২০২৪
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
।। আনিসুজ্জামান ।।
ইমদাদুল হক মিলনের বাষট্টি বছরপূর্তি উপলক্ষে আমরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠব, সেটা স্বাভাবিক। বয়সের হিসাবে বাষট্টি বছর এখন কিছুই নয়, তবু তা যে পরিণতির দিকে জীবনযাত্রাপথে একটা মাইলফলক, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। যিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করলেন, তিনি বাংলাদেশ-উত্তর প্রথম প্রজন্মের লেখক, আমাদের একজন প্রিয় লেখক-বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে এবং পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি বাস করে, সেখানেই প্রিয় লেখক। অনুজপ্রতিম মিলন আমার প্রিয় মানুষও। ভাবতে ভালো লাগে, যে জগন্নাথ কলেজে একদা আমি আইএ পড়েছি, বহুকাল পরে সেখানেই মিলন এইচএসসি এবং অর্থনীতিতে অনার্স পড়েছিল। আমার সঙ্গে তার এখানেই মিলের প্রথম এবং শেষ।
মিলনের সাহচর্য আমি সব সময় উপভোগ করি। একসময় তার সঙ্গে অনেক আড্ডা হতো, এখন হয় না। কিন্তু যখনই দেখা হয় তার সঙ্গে, নৈকট্যের বোধ গভীরভাবে অনুভব করি। একবার সে একাধিক দিন ধরে খুব ধৈর্যসহকারে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ‘অন্যদিন’ পত্রিকার জন্য। তাতে আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। ‘কালি ও কলম’ পত্রিকা বের করার সময় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার জন্য আমরা উপন্যাস দাবি করেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলনের কাছে। উভয়েই অনুকূল সাড়া দিয়ে আমাদের বাধিত করেছিলেন। মিলনের উপন্যাসটির নাম ছিল ‘পর’, পরে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
মিলনের বইয়ের সংখ্যা কত, তা আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রথম থেকেই সে পাঠকের সাড়া জাগিয়েছিল। তার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মিলন একসময় জার্মানিতে থেকেছিল বছর তিনেক। জার্মানিতে বাঙালি অধিবাসীর কঠোর জীবনসংগ্রাম নিয়ে সে লিখেছিল ‘পরাধীনতা’। উপন্যাসের শেষে তার মুখ্য চরিত্র কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়, তার শেষ দুটি বাক্য এ রকম : ‘তবুও দেশে ফিরব আমি। আমার দেশের জেলখানাও ভাল।’ এটা পড়ে পাঠক অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারে না।
গল্পকথনে মিলনের দক্ষতা অসাধারণ। কি মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন, কি নিম্নবিত্ত গ্রামীণ জীবন, কি প্রেম, কি জীবনসংগ্রাম_সব বিষয়েই গল্প বলায় সে সিদ্ধহস্ত। তিন খণ্ড ‘নূরজাহান’ তার অবিস্মরণীয় কীর্তি। ১৯৯৩ সালে মৌলভীবাজারের এক গ্রামে ফতোয়ার শিকার নূরজাহান আত্মহত্যা করলে সারা বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই নূরজাহানকে নিয়েই তার এই উপন্যাস। উপন্যাসে মিলন নূরজাহানকে স্থাপন করেছে লেখকের মামাবাড়ি বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডলে। কেননা মৌলভীবাজারের আঞ্চলিক ভাষা তার অধিগম্য নয়। বইতে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার সুনিপুণ ব্যবহার আছে-কেবল সংলাপে নয়, বর্ণনার অংশেও। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার নিয়ে মিলন অনেক দিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসেছে। প্রথম উপন্যাসেই সে এ পরীক্ষা শুরু করেছিল। অন্যদিকে ‘কালাকাল’ উপন্যাসটি সে লেখে সম্পূর্ণতই আঞ্চলিক ভাষায়। ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে প্রথম দিকে সে অনেক আঞ্চলিক শব্দের শুদ্ধরূপটি উল্লেখ করেছে বন্ধনীর মধ্যে, পরে আর তার প্রয়োজন বোধ করেনি। বস্তুত প্রমিত রূপটি দেওয়ার তেমন দরকার ছিল না। লেখকের মতে, আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার সত্ত্বেও প্রথম দু’পর্বে আঞ্চলিক ভাষার সুরটি সেভাবে আসেনি, এসেছে তৃতীয় পর্বে। এই সুর ব্যাপারটায় সচেতনতা তার শিল্পীসত্তাকেই প্রকাশ করে।
‘নূরজাহান’ উপন্যাসে গ্রামসমাজের যে ছবি দেখি, মনে হয়, তা বাংলাদেশের গ্রামসমাজের প্রতিনিধিস্থানীয়। মানুষ আর প্রকৃতির বৈচিত্র্য আছে সেখানে, আছে স্বপ্ন আর বাস্তবের দ্বন্দ্ব। মৌলবাদ কীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, কারা তার ধারক-বাহক ও সহায়ক শক্তি, তার একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায় এতে। এর আগে নারায়ণগঞ্জের পতিতাপল্লীতে বিক্রি হওয়া এবং পরিণামে নিহত হওয়া শবমেহেরকে নিয়ে মিলন লেখে ‘টোপ’ উপন্যাস। বাংলাদেশে নারীর অসহায়তার আশ্চর্য সুন্দর দলিল এ বই দুটি। শিল্পীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
উপন্যাস তার প্রধানতম সৃষ্টিক্ষেত্র হলেও আত্মপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম নয়। সে চমৎকার ছোটগল্প লিখেছে, টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখে খ্যাতি লাভ করেছে, তার কিশোরপাঠ্য রচনাও খুব জনপ্রিয়। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ছাড়াও সে অনেক পুরস্কার পেয়েছে। জাপান ফাউন্ডেশন আয়োজিত তাকেশি কায়েকো মেমোরিয়াল এশিয়ান লেকচার সিরিজে বক্তারূপে তার আমন্ত্রণ লাভ খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ এক বিরল সম্মান তার এবং আমাদের দেশের।
মিলনকে তার জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা। অনেক অনেক দিন ধরে সে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করুক।
শিক্ষাবিদ।
নোট: সমকাল থেকে নেয়া।
Our facebook page