Latest News
ফেনীতে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে শিক্ষার্থী নিহত
মে ১৯, ২০২৪
বান্দরবানে বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
মে ১৯, ২০২৪
গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ৪
মে ১৯, ২০২৪
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
টানা ২৫ বছর ক্ষমতায় থেকে গত ফেব্রুয়ারি-মার্চের ভোটে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে যদিও সিপিএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী) ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল; কিন্তু ভোটের অঙ্কে তাদের অবস্থান ছিল বিজেপির প্রায় সমানে সমান। ৪৫ ভাগ ভোট পায় তারা ওই নির্বাচনে।
ভারতে সিপিএমের আরেক দুর্গ বলা হয় কেরালাকে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা সেখানে ৪৩.৩১ শতাংশ ভোট পায়। ত্রিপুরা ও কেরালায় বিভিন্ন নির্বাচনে স্থানীয় সিপিএমের জয়-পরাজয় থাকলেও তাতে সংগঠন ভেঙে পড়ার কোনো পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের পরিস্থিতিকে উল্টোই বলা যায়। কেবল যে এই রাজ্যে ১৪ মে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ স্থানীয় সরকার ভোটে (পঞ্চায়েত নির্বাচন) তারা ভীষণভাবে হেরেছে তাই নয়, ক্রমে সাংগঠনিকভাবে দলটি মাঠ থেকে উধাও হয়ে পড়ছে এবং ভোটের হিস্যাও তাদের কমছে দ্রুতলয়ে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, এবারের নির্বাচনে রাজ্যে অনেক স্থানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস প্রচুর আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। ফলে এই নির্বাচনে সিপিএম কম আসন পেলেও ভোটের হিসাবে তার অবস্থান যে খারাপ, সেটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এই রাজ্যের পাঁচ কোটি ভোটারের প্রায় পৌনে দুই কোটিই ভোটের হিসাবের বাইরে থাকছে।
এই বক্তব্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমরা সর্বশেষ নির্বাচনকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গত এক দশকের অন্যান্য নির্বাচনের দিকে তাকাতে পারি। সর্বশেষ ১০ বছরে রাজ্যটিতে ছোট-বড় ছয়টি নির্বাচন হয়েছে। দুটি পঞ্চায়েত ভোট, দুটি বিধানসভা ভোট এবং দুটি লোকসভা ভোট। এই ছয় দফা ভোটে সিপিএমের ভোট হিস্যা ছিল এ রকম : ৪৯.৫৭, ৪৩.৩, ৪১.০৫, ৩৮.১৯, ২৯.৯৫ এবং ২৫.৬৯ শতাংশ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ মে ২০১৮)। অর্থাৎ গত এক দশকের ব্যবধানে সিপিএম তথা ‘বামফ্রন্ট’ পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে তার সমর্থন অর্ধেক হারিয়ে ফেলেছে। আসনের হিসাবে এই অবস্থাটি আরও ভয়াবহ। যেমন- এবার পঞ্চায়েত ভোটে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস, যেখানে প্রায় ২১ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছে সেখানে সিপিএম জিতেছে এক হাজার তিনশ’র মতো আসনে। প্রায় ৩২ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোট হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যাও সিপিএমের বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে বেশি। অনেক স্থানে সিপিএম প্রার্থী দেওয়ার মতো ভালো নেতা খুঁজে পায়নি- এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে প্রচারমাধ্যমে। এটা ছিল প্রকৃতই এক করুণ সংবাদ। কারণ, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য মডেলতুল্য পশ্চিমবঙ্গের এই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একদা সিপিএমই গড়ে তুলেছিল- ১৯৭৭ সালে যখন তারা ৩৪ বছর স্থায়ী এক ক্ষমতাকাল শুরু করে, তার দ্বিতীয় বছরেই।
বলাই বাহুল্য, ইতিমধ্যে ভাগীরথী-হুগলি-গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছর সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে কৃষি সংস্কার এবং স্থানীয় সরকারে অসাধারণ যেসব পদক্ষেপ নিয়ে নিজেকে দুর্ভেদ্য করে তুলেছিল, পরের দশকগুলোতে ক্রমেই সেই ধারাবাহিকতা আমূল পাল্টে যায়। গুজরাট-অল্প্রব্দ-মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মতো করে পশ্চিমবঙ্গেও নয়া উদারবাদী পুঁজিতান্ত্রিক উল্লম্ম্ফন ঘটাতে যায় ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টিটি। এতে পার্টিতে নেতৃত্ব পর্যায়ে মধ্যবিত্তের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা জেঁকে বসে। আদর্শবাদিতার বদলে ‘সুযোগ-সুবিধার জন্য পার্টি করা’ লোকের সংখ্যাও বেড়ে যায় হুহু করে। দূরত্ব তৈরি হয় সমাজের নিচুতলার আদিবাসী-দলিত-মুসলমানদের সঙ্গে। এমনকি নারীমুক্তির সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ সিপিএমের প্রতি নারী ভোটারদের আগ্রহেও ব্যাপক ভাটা পড়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় থাকার কুফলই বলা যায়- স্থানীয় ক্যাডাররা একেকজন ক্ষুদে মাফিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ এই ‘মাফিয়া’দের ঘৃণা করতে গিয়ে লাল পতাকাকেই প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে এখন। মমতার ধাক্কা খাওয়ার-পাওয়ার পর ৩১নং আলাউদ্দিন স্ট্রিটের মুজাফ্ফর আহমেদ ভবনের (সিপিএমের কার্যালয়) বাসিন্দারা ক্রমে আবিস্কার করছেন যে, পুরো কাঠামো অনেক আগেই ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল।
তবে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতৃত্ব আদৌ পরিস্থিতির গভীরতা আঁচ করতে পেরেছেন এমনও মনে হয় না। কারণ রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে যখন অনেক এলাকাতেই তারা
যোগ্য প্রার্থী সংকটে ভুগছিল, তখনও মুখ্য নেতাদের দেখা গেছে হায়দ্রাবাদ পার্টি কংগ্রেসে এই মর্মে বিতর্ক করে যেতে- আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়া সঠিক হবে কি-না। কার্যত সিপিএম নেতাদের এই বিতর্কের উত্তর দিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা। ভোটে জাতীয় কংগ্রেসের ফল দাঁড়িয়েছে সিপিএমের চেয়েও খারাপ। তৃণমূল যেখানে ২১ হাজার ১১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছে, সেখানে কংগ্রেস জিতেছে ৬৩৪টি। বলাই বাহুল্য, সিপিএম-কংগ্রেস জোট আপাত আর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কোনো তাৎপর্য বহন করে না। যদিও গত মাসে সিপিএমের হায়দ্রাবাদ কংগ্রেসে এরূপ জাতীয় জোটের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ওকালতি করেছে সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ নেতৃবৃন্দ। এ ক্ষেত্রে তারা কেরালা এবং ত্রিপুরা নেতৃত্বকে পরাস্ত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ২২তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ শাখার এই ‘বিজয়’-এর বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভোটবার্তাটি যেন চপেটাঘাতের মতোই মনে হচ্ছে।
তবে কেবল ভোটের হিসাবেই নয়, সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ শাখায় অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক সংকটও একটা বড় দুর্যোগের আভাস দিচ্ছে। ২০১০ সালের পড়ন্ত বেলাতেও এই রাজ্যে পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার। গত বছর তা দাঁড়ায় দুই লাখে (স্ট্ক্রল.ইন, ৩০ আগস্ট)। একই সময়ে ‘হোল টাইমার’ বা পূর্ণকালীন সদস্যসংখ্যা তিন হাজার ৬০০ থেকে কমে দুই হাজারে দাঁড়িয়েছে। একদা এই রাজ্যে সিপিএম তার প্রধান অঙ্গ সংগঠন কৃষকসভা নিয়ে গর্ব করত। যার সদস্যসংখ্যা এক দশকে অর্ধেক হয়ে গেছে। সবচেয়ে ‘উদ্বেগজনক’, দলটি আর বাঙালি তরুণ-তরুণীদের পূর্বের মতো আকর্ষণ করতে পারছে না। ভারতজুড়ে যখন জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশের বয়স ৩৫-এর নিচে, পশ্চিমবঙ্গে তখন সিপিএমের সদস্য সংখ্যায় ৩১-এর কম বয়সীদের হিস্যা ২০ শতাংশের নিচে (ডেকন হেরাল্ড, ২০ এপ্রিল, ২০১৮)। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কাস্তে-হাতুড়ির স্থানীয় অভিভাবকরা কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য করে ভবিষ্যতে টিকে থাকার যে চেষ্টা করবেন বলে ভরসায় ছিলেন ১৪ মের নির্বাচন তাদের জন্য নির্মম এক বাস্তবতা হাজির করেছে।
এই পরিস্থিতি দলটিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়েও অভ্যন্তরীণ বিতর্ক আরও তীব্র হবে। কেরালা ও ত্রিপুরা ইউনিট কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্যের চেষ্টা বাদ দিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর যে ‘লাইন’ নিয়েছে তার পক্ষে সমর্থন বাড়বে এবং অভ্যন্তরীণ মতদ্বৈধতা জাতীয় নির্বাচনকালে প্রকাশ্য রূপ নিয়ে হাজির হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। সর্বশেষ হায়দ্রাবাদ কংগ্রেসেও দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গ যখন জানাচ্ছিল তাদের সদস্য কমছে- কেরালা পার্টি তখন জানায়, তাদের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে। এদিকে সিপিএমের অবক্ষয় ও ক্রমে বিলীন হয়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাবিন্যাসেও এক ধরনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। তারই ফল ছিল এবারের নির্বাচনে সহিংসতার ব্যাপকতা। অন্তত ১৩ ব্যক্তি মারা গেছেন নির্বাচনী সহিংসতায়। এই নির্বাচনী সহিংসতা এও ইঙ্গিত দিচ্ছে, ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন এখানে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে। আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ মুহূর্তে বিভিন্ন রাজ্যে যেসব স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে, তাকে এক ধরনের মতামত জরিপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সেই বিবেচনা থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের দখল প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেখা গেল, সিপিএম তাতে একটিও জেতেনি। ২০টিই জিতে নিয়েছে তৃণমূল। এটা যেন কফিনে পেরেকের শব্দের মতো।
এই দৃশ্যপটের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো, আগামীতে বাংলাদেশের ঘরের কাছে মমতার তৃণমূলের সামনে প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে- কংগ্রেস ও সিপিএমকে পেছনে ফেলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এই সূত্রেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ পঞ্চায়েত ভোটের ফল স্থানীয় বামদের জন্য যেমন এক সতর্কবার্তা, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক। সূত্র: সমকাল।
Our facebook page