Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
।। হাছান আদনান ।।
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা গাড়ি ঋণ নেন আকতারুজ্জামান। শুধু প্রসেসিং ফি বাবদই বেসরকারি এ চাকরিজীবীর নেয়া ঋণের ১ শতাংশ কেটে রাখে ব্যাংকটি। এছাড়া লোন অ্যাপ্লিকেশন ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, লিগ্যাল ফি, মর্টগেজ ফি, হিসাব পরিচালন ব্যয়সহ ১২-১৫ ধরনের চার্জ কেটে রেখে ব্যাংক ওই গ্রাহককে দিয়েছে নগদ ১৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাকি ৬০ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখা হয়েছে।
তিন বছরের জন্য নেয়া ওই ঋণ দেড় বছরের মাথায় ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন আকতারুজ্জামান। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে মোট ঋণের ২ শতাংশ হারে আরো ৪০ হাজার টাকা আর্লি সেটলমেন্ট ফি বাবদ দিতে হয়েছে তাকে। সে হিসাবে ১২ শতাংশ সুদে নেয়া গাড়ি ঋণে ২০ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে এ গ্রাহককে।
দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া এ ধরনের ছোট গ্রাহকদের ওপরই সার্ভিস চার্জের চাপ বেশি। বড় গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিতে তাদের সার্ভিস চার্জ খুব বেশি দিতে হয়নি। ব্যাংকের কর্মকর্তারাই নিজে থেকে সমঝোতা প্রস্তাব দিয়ে অনেক চার্জ কমিয়ে দেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য ফাইভ স্টার মানের হোটেলের মতো ব্যাংক দরকার নেই। মুদিদোকানের মতো ব্যাংকের শাখা হলেই গ্রাহকের বেশি উপকার হয়। জাঁকজমকপূর্ণ শাখা পরিচালনা করতে গিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে বহু ধরনের চার্জ কেটে রাখে। তিনি বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার ব্যবসায়িক প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের সুদহারের তুলনায় বেশি। এ অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জ যুক্ত হলে ব্যাংকঋণের সুদহার আরো বেড়ে যায়। সব শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য ব্যাংকঋণের সুদহার ও সার্ভিস চার্জ সমান হওয়া দরকার। বড়, প্রভাবশালী কিংবা ব্যাংকের পরিচালনা-সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ সুবিধা গ্রহণযোগ্য নয়।
জানা গেছে, লোন অ্যাপ্লিকেশন ফি, লোন প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, সার্ভিস চার্জ, লিগ্যাল ফি, অ্যাপ্রাইসাল ফি, সার্ভে ফি, মর্টগেজ ফি, আর্লি সেটলমেন্ট ফি, ব্যাংক গ্যারান্টি, মনিটরিং ফি, রিনিউয়াল ফিসহ নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহককে ব্যাংক ১ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিলেও গ্রাহক পাচ্ছেন গড়ে ৯৮ লাখ টাকা। বাকি ২ লাখ টাকা ঋণ বিতরণের আগেই সার্ভিস চার্জ বাবদ কেটে রাখছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। অথচ ঋণের পুরো টাকা না পেয়েও গ্রাহককে এর ওপর সুদ দিতে হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের ব্যাংক মেঘনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, কোন কোন সেবার ক্ষেত্রে ব্যাংক চার্জ নিতে পারবে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছে। চার্জ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক হয়তো কম নেয়, অন্য ব্যাংক বেশি নেয়। সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে একই ধরনের চার্জ থাকে না। অনুমোদিত চার্জের বাইরেও কোনো ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে অনৈতিক চার্জ আদায় করে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো ঘটনা হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক ধরতে পারে, কোনোটি ধরতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যাংক সব প্রস্তাবের বিপরীতে ঋণ বিতরণ করতে পারে না। ঋণ বিতরণের জন্য একাধিকবার সরেজমিন পরিদর্শন করতে হয়। ১ কোটি টাকা ঋণের ক্ষেত্রে সব ধরনের চার্জ মিলিয়ে ১ লাখ টাকাও হতে পারে, আবার ৫ লাখ টাকাও হতে পারে।
বিভিন্ন ব্যাংকের জুন মাসে ঘোষিত সুদহারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো বড় ও মাঝারি শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। ক্ষুদ্রশিল্পে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এসব শিল্পের চলতি মূলধন ঋণের সুদহারও প্রায় একই।
এ সুদহার আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ। ঋণ পেতে হলে ব্যাংক প্রসেসিং ফি দেয়া লাগে। ব্যাংকভেদে এই হার ১ থেকে ২ শতাংশ। ঋণ নিতে গেলে মর্টগেজ অবশ্যই জমা দিতে হয়। মর্টগেজ তৈরির ফি ২ শতাংশের কম নয়। ১ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত মর্টগেজ প্রস্তুত করতে ২ হাজার টাকা ফি লাগে। ২০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার মর্টগেজ প্রস্তুতিতে ফি লাগে ৫ হাজার টাকা। এরচেয়ে বেশি অংকের মর্টগেজ করতে ৫ হাজার এবং প্রতি লাখে ২ শতাংশ হারে ফি দিতে হয়। এর বাইরে রয়েছে সরকারি বিভিন্ন স্ট্যাম্পের নির্ধারিত মূল্য।
ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইবি ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এজন্য নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। ঋণের জন্য ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কিছু কাগজপত্র জমা রাখতে হয়। এজন্য ব্যাংকে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা ফি দেয়া লাগে। কোনো কোনো ব্যাংক এজেন্ট কমিশনও আদায় করে ২ থেকে ৩ শতাংশ। ব্যাংকের জামানতের নিরাপত্তার জন্য দিতে হয় ১ থেকে ২ শতাংশ কমিশন। ঋণের অংক যত বেশি হবে, কমিশনের অংকও তত বেশি।
ধাপে ধাপে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে দিতে হয় কমিটমেন্ট ফি। অবশিষ্ট অংশের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হয়। একজন গ্রাহককে যদি ৫০ কোটি টাকার ঋণ প্রদানের অনুমোদন করে ব্যাংক এবং ওই গ্রাহক ২০ কোটি টাকা নিয়ে বাকিটা পরবর্তী সময়ে নিতে চান তাহলে ওই ৩০ কোটি টাকার ওপর ১ থেকে ২ শতাংশ হারে সুদ আদায় করে ব্যাংক।
কোনো গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই তার ঋণ পরিশোধ করতে চান তাহলে তাকে বিতরণকৃত ঋণের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে সিন্ডিকেশন ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে চুক্তি অনুযায়ী কিছু চার্জ দিতে হয়। এছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণের ক্ষেত্রে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু চার্জ। এর বাইরে ঋণ নিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ব্যাংক হিসাব খুলতে হয়। ওই ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় চার্জসহ ঋণের সুদহার ২০ থেকে ২৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ রয়েছে। ব্যাংক যেহেতু একটি সেবা দিচ্ছে, সেহেতু চার্জ রাখবে এটিই স্বাভাবিক। ব্যাংকের অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। খেলাপি ঋণের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংককে সার্ভিস চার্জ রাখতে হয়। তবে অতীতের মতো এখন আর সার্ভিস চার্জ কাটা হয় না। ব্যাংকগুলো নিজে থেকেই অনেক ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ কমিয়ে এনেছে। বিভিন্ন চার্জ কমিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছে। আগামীতে সার্ভিস চার্জ আরো কমে আসবে বলেই আমি মনে করি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকও হয়তো সার্ভিস চার্জ নেয়া বন্ধ করে দেবে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ চীন, জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ওইসব দেশের ব্যাংকগুলোয় ঋণের প্রসেসিং ফি বাবদ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ পর্যন্ত কাটা হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মতো এত বেশি সার্ভিস চার্জের খড়্গ অন্য দেশের ব্যাংকগুলোয় নেই। ভোক্তা ঋণের মতো ছোট ছোট ঋণে হরেক রকমের সার্ভিস চার্জের অস্তিত্বও বিশ্বের কোনো ব্যাংকে পাওয়া যায়নি। তবে বড় অংকের ঋণ নিয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিতে তাদের সার্ভিস চার্জ খুব বেশি দিতে হয়নি। ব্যাংকের কর্মকর্তারাই নিজে থেকে সমঝোতা প্রস্তাব দিয়ে অনেক চার্জ কমিয়ে দেন। ছোট ঋণ নিতে গেলেই গ্রাহককে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কোনো হিডেন চার্জ নেই। প্রসেসিং ফি, আর্লি সেটেলমেন্ট ফিসহ বিভিন্ন নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ধরনের চার্জ আদায় করে, সেটিও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আদায় করে না। নানা ধরনের চার্জের নামে বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ধরনের চার্জ আদায় করে, সেগুলো অনেক বেশি।
তবে গ্রাহকদের হয়রানি, দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, সিবিএ নেতা ও কর্মকর্তাদের কমিশন দেয়ার মতো ঝামেলা এড়াতে সাধারণ গ্রাহকরা সরকারি ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী। প্রসেসিং ফি, আর্লি সেটেলমেন্ট ফিসহ রকমারি অনেক ফি দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকে নেই বলে জানান মাহমুদুর রহমান। ইসলামী ব্যাংক ফার্মগেট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ব্যাংকার বলেন, বেসরকারি অনেক ব্যাংক নিজেদের অভিজাত পরিচয় দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ আদায় করে। এটি এক ধরনের অপরাধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, এর আগে ব্যাংকগুলোর সুদহার ও চার্জ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কথা বলতে হতো না। ব্যাংকগুলো নিজেদের নীতি-আদর্শ অনুযায়ীই এগুলো নির্ধারণ করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার ও চার্জ নিয়ে একাধিক সার্কুলার জারি করেছে। এর পরও ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত চার্জের কারণে কোনো গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমাদের কাছে আবেদন জানালে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্ভিস চার্জের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
সূত্র: বণিক বার্তা।
Our facebook page