Latest News
ফেনীতে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে শিক্ষার্থী নিহত
মে ১৯, ২০২৪
বান্দরবানে বন্দুকযুদ্ধে ৩ কেএনএফ সদস্য নিহত
মে ১৯, ২০২৪
গোপালগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ৪
মে ১৯, ২০২৪
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
খ্রিষ্টাব্দ ২০১৮। বছরটা বুঝি নির্বাচনের। তৃণমূল স্তর থেকে শহর-নগরের করপোরেশন হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দামামা বাজতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে তার প্রকাশ। ইতিমধ্যে স্থগিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া ফের শুরু হয়েছে। সেটাই বর্তমান আলোচ্য বিষয়- প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা।
খুলনার নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক, পরাজিত বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ভোটের ব্যবধান অনেক। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি, হয়েছে দলীয় নিয়ন্ত্রণে। তারা এ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বলা চলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দাবি, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তাই বিএনপির আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। উল্লেখ্য, বিএনপি তার বিভ্রান্তিকর নির্বাচন বর্জনের নীতি অনুসরণ করে দীর্ঘদিন নির্বাচনের ময়দানে অনুপস্থিত ছিল। স্বভাবত ভোটার জনতার সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাদের।
কেমন হয়েছে খুলনার মেয়র নির্বাচন? দলীয় মতামতের বাইরে বাস্তবচিত্রটা কেমন তা অকুস্থলে উপস্থিত কর্তৃপক্ষ এবং সাংবাদিকরাই ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য জানেন সাধারণ মানুষ। নির্বাচন কমিশন অবশ্য কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এমন মতামতই প্রকাশ করেছে। এবার দেখা যাক এ বিষয়ে গণমাধ্যমের মতামত কেমন? আপাতত দৈনিক সংবাদপত্রের কয়েকটি শিরোনাম তুলে ধরা যাক। এদের একটিতে বলা হয়েছে- বাইরের ‘পরিবেশ দৃশ্যত শান্ত, তবে (তা) সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে’। অন্য একটিতে শিরোনাম : ‘বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট, বিক্ষিপ্ত সহিংসতা’। তৃতীয়টির মতামত : ‘খুলনা সিটিতে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হয়েছে’।
আরও একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘অর্পিত দায়িত্ব পালনে ইসি ব্যর্থ হয়েছে’। তাদের মতে, এই ‘নির্বাচন পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’। এ মন্তব্যের সমর্থনে তারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছে। একই কাগজের একটি উপসম্পাদকীয়তে ব্যঙ্গাত্মক শিরোনাম খুলনার নির্বাচন সম্পর্কে। সংবাদপত্র বিশ্নেষণে এমন মতামতেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দুই
ইতিপূর্বে রংপুরে যে নির্বাচন হয়ে গেল, তা নিয়ে এতটা ধুলোঝড় ওঠেনি। খুলনার ক্ষেত্রে উঠেছে। প্রসঙ্গত একটি কথা অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, এ দেশীয় রাজনীতিতে গত কয়েক দশকে এক ধরনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে, সে পরিবর্তন নীতি-নৈতিকতা বিচারে নেতিবাচক, যা তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যেও গ্রহণযোগ্য নয়।
নিয়মতান্ত্রিক-গণতন্ত্রী রাজনীতিতেও পশ্চিমা বিশ্বে যে সহিষুষ্ণতা, ইতি-নেতিকে মান্য করার যে সংস্কৃতি, তা এখন এ দেশে দৃশ্যত অনুপস্থিত। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে (বিশেষ করে সংসদীয় নির্বাচনে) একটি ন্যক্কারজনক, জঘন্য ধারাই বলা উচিত, তা হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বা নির্বাচন পূর্বকালে হুমকি কিংবা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধা সৃষ্টি।
লক্ষণীয় যে, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি। তবে যে কথা আগে বলেছি তা হলো- অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, ন্যায়নীতি সঙ্গত নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ প্রায়শ পুরোপুরি উপস্থিত থাকে না। তাই অভিযোগ পরাজিত পক্ষ থেকে উঠতেই থাকে। একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় স্থিতি পায়নি। অধিকাংশ সময়েই তা অবাঞ্ছিত, বিরূপ পরিবেশের প্রভাবাধীন হয়েছে।
কারও কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে; তবু বলি পূর্ববঙ্গে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনটির কথা। একটি ফ্যাসিস্ট চরিত্রের সরকারের অধীনে নির্বাচনটি কীভাবে অবাধ-সুষ্ঠু চরিত্রে হতে পেরেছিল, যে কারণে সরকারবিরোধী যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভে সমর্থ হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের লজ্জাজনক পরাজয়ের পরও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।
একইভাবে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি পরাজিত পক্ষ; এমনকি সামরিক সরকার। অবশ্য তারা এ নির্বাচনী ফলাফলকে অকার্যকর ও নস্যাৎ করেছিল অন্য কৌশলে, ভিন্ন কায়দায়, শেষ পর্যন্ত এক ভয়াবহ রক্তাক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ নির্বাচন পদ্ধতির বিষয় নয়। এ দুটি নির্বাচনেই উপস্থিত থাকায় এর পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা করতে অসুবিধা হয়নি।
তিন
একটি রক্তস্নাত, বহু লাখো প্রাণের বিনিময়ে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সাড়ে চার দশকেও কেন আমরা নির্বাচনসহ একাধিক খাতে সুস্থ, সুষ্ঠু অবকাঠামো তৈরি করতে পারিনি, কেন একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, পক্ষপাতহীন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ চরিত্র ধরে রাখতে পারিনি- সেটাই আমার বড় প্রশ্ন। সেটা যে সম্ভব তাও মাঝেমধ্যে দেখা গেছে। তবু তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। কেন? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে।
শুধু খুলনার নির্বাচন নয়, ইতিপূর্বে কোনো কোনো নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখনই এ কথাগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খুলনা নির্বাচন নিয়ে দু’চারটি নিবন্ধ পড়েও মনে হয়েছে, রাজনৈতিক বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে এখনও আমরা সর্বদা মুক্ত-স্বাধীন-নিরপেক্ষ (দল-নিরপেক্ষ) চেতনার অধিকারী হতে পারিনি, অন্তত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তো নয়ই।
যখন বলি ‘শুভশক্তি’র কথা, ‘সহনশীলতার কথা’, ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা-আস্থা’ ও আধুনিক চেতনার কথা, তখনও সেখানে দল-নিরপেক্ষতার ঘাটতি থাকে, তাতে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে না। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব শুদ্ধ গণতন্ত্রী চেতনার রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটাতে না পারলেও তারা অন্তত অবাধ নির্বাচন ব্যবস্থার অবকাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। সেখানে জয়-পরাজয় নিয়ে রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি বড় একটা দেখা যায় না।
এটুকুও আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় অর্জিত হয়নি। আমি বলছি না, এদিক থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ধোয়া তুলসী পাতা। ছোট বুশ সাহেবের নির্বাচনী জয় নিয়ে তো সঙ্গত প্রশ্নই উঠেছিল; তবু অন্যায়ভাবে পরাজিত প্রার্থী ক্ষুব্ধ আল গোর তা নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়েও ঐতিহ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, যা সঠিক মনে করি না। তবে এ ধরনের ঘটনা বিলেতি নির্বাচনী ব্যবস্থা ও কর্মকাণ্ডে বড় একটা দেখা যায় না।
শেষোক্ত ব্যবস্থা ও পদ্ধতিটিই তো আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু গ্রহণ নীতিগত দিক থেকে পূর্ণমাত্রা সিদ্ধ নয় বলেই যত সমস্যা। সমস্যা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে, প্রশ্ন এর পদ্ধতিগত দিক নিয়ে, এর নির্দোষ, নীতিসিদ্ধ পরিচালনা নিয়ে, যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতির শুদ্ধতার অভাব প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় না।
পত্রপত্রিকায় লেখক-কলামিস্টদের বিচার-ব্যাখ্যা যাতে প্রকৃত রাজনৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করে না যায়, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও জানি, এসব লেখার কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না রাজনৈতিক মহলে-কি ক্ষমতাসীন, কি কথিত বিরোধী দলে। প্রত্যেকে যে যার অঙ্ক কষার নিরিখে পথ চলে, সহিষুষ্ণতা বা যথার্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন তাতে সামান্যই দেখা যায়।
আর সে জন্যই প্রবীণ সাংবাদিককে ভিন্ন মাত্রায় কলম ধরতে হয় (কলম নয়, কম্পিউটারের কি-বোর্ডে আঙুল চালাতে হয়), প্রশ্ন ওঠে খুলনার নির্বাচন নিয়ে। আবার কেউ বিপরীত ধারায় নরম পন্থায় প্রত্যাশা রাখেন, যাতে পরবর্তী নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও অবাধ চরিত্রের হয়; কিন্তু তাতে কি ভবী ভুলবে।
খুলনার নির্বাচন মোটামুটি শান্ত হলেও কতটা নীতিনিষ্ঠ হয়েছে, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। প্রশ্নের বৈধতা- সংবাদপত্রে প্রকাশিত নির্বাচন বিষয়ক সহিংসতার খবরগুলো, এমনকি জাল ভোটের বিবরণগুলো। নির্বাচন কমিশনকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, অনেক কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি বা নির্বাচন স্থগিত করতে হয়েছে। তাহলে তারা কীভাবে দাবি করেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও যথাযথ চরিত্রের হয়েছে?
অবশ্য উপমহাদেশের অবশিষ্ট গরিষ্ঠ আয়তন অংশ কি এদিক থেকে খুব একটা ভিন্ন? তেমন তো মনে হয় না। পাকিস্তান তো এ ব্যাপারে দুষ্টু উদাহরণ। কিন্তু গণতন্ত্রী ভারত? তাদের অবস্থাও কি খুব একটা ভালো? সেখানকার উচ্চ আদালত নিয়ে এ দেশের আইনি মহলে অনেক সদর্থক কথা বলা হলেও সম্প্রদায় চেতনার ছায়াপাত থেকে কি তারা পুরোপুরি মুক্ত?
শুধু কি বিজেপি আমল? কেন্দ্রীয় কংগ্রেসী শাসনামলে, এমনকি স্বনামখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের শাসনামলে বাবরি মসজিদে রাম মন্দিরের শিলান্যাস প্রধানমন্ত্রীর হাতে- বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য। সেখানে ছিল ইতিপূর্বে উচ্চ আদালতের রায়ে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) বজায় রাখার কথা; কিন্তু তা ভাঙা সত্ত্বেও উচ্চ আদালত রা কাড়েনি। আর হতভাগ্য মেয়ে ফেলানির হত্যা মামলা তো উচ্চ আদালতেই স্থিতিতে বসবাস করছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। এই তো গত ১৬ এপ্রিল একটি খবর, পশ্চিমবঙ্গের। শিরোনাম- ‘পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ও বিপন্ন গণতন্ত্র’।
সত্যি কথাটা হলো, গণতন্ত্র কি আদৌ কোথাও সঠিক মাপে বিরাজমান? ভারতীয় উপমহাদেশের ত্রিধাবিভক্ত রাষ্ট্রে কোথাও কি গণতন্ত্রের সোনার হরিণের দেখা মেলে? সমাজতন্ত্র তো বর্জিত। গণতন্ত্রেরও বেহাল দশা। তাহলে কোন ‘তন্ত্র’ নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি পথ চলবে? পাঠক, প্রশ্নটির জবাব পেতে ভাবনাকে যেন যুক্তিতর্কের গভীরে নিয়ে যান।
শেষ কথা, অন্য সবার মতো আমারও- নির্বাচন কমিশন যেন খুলনা নির্বাচনকে আদর্শ না ভেবে সেখানকার ভুলত্রুটি ও অন্যায়গুলো সংশোধন করে নেয়। তাদের দু-একজন পূর্বসূরির কথা মনে রেখে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পরবর্তী সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো পরিচালনা করে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন- সে ক্ষেত্রে যেন সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা ভাবতে হয় আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে।
সিটি করপোরেশন সম্বন্ধে আর একটি কথা- এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, এখানে জাতীয় ইস্যু নয়, স্থানীয় চাহিদাই প্রধান ইস্যু- দলগুলোকে এ সত্য মনে রাখতে হবে। যিনি এ কথা মনে রেখে কাজ করবেন, জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন, জয় সম্ভবত তার পক্ষেই যাবে।
ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক। সূত্র: সমকাল।
Our facebook page