ভারতের প্রধানমন্ত্রী রবিবার নিজের নামের আগে চৌকিদার শব্দটি জুড়ে টুইটারে নিজের নতুন নামকরণ করেছেন ‘চৌকিদার নরেন্দ্র মোদী’।
এরপর ভারতের মন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের মধ্যেও নিজের নামের সঙ্গে চৌকিদার যোগ করার হিড়িক পড়ে গেছে – আর তারা বলছেন যারাই দেশের দুর্নীতি ও সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়ছেন তাদেরই উচিত হবে এই নতুন উপাধি নেওয়া।
দুর্নীতির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে লাগাতার আক্রমণ করে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী এর আগে যে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান তোলা শুরু করেছিলেন, তার মোকাবিলায় বিজেপি এখন এভাবেই পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় যেতে চাইছে।
কিন্তু ভারতে আসন্ন নির্বাচনের আগে ‘চৌকিদার’ কীভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এল?
আসলে রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনায় কথিত দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে গত কয়েকমাস ধরে একের পর এক জনসভায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন।
তিনি ‘চৌকিদার’ বলামাত্র তার সমর্থকরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠছেন ‘চোর হ্যায়’ বলে!
কিন্তু এখন নিজে থেকেই নামের আগে সেই চৌকিদার যোগ করে পাল্টা আক্রমণে যেতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী।
তার দেখাদেখি টুইটার হ্যান্ডলে বিজেপির শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীরাও এখন ‘চৌকিদার অমিত শাহ’ বা ‘চৌকিদার রাজনাথ সিং’ নাম নিয়েছেন।
বিজেপির মন্ত্রী ও মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকর বলছেন, “কংগ্রেস কিন্তু চৌকিদারকে সম্মান করে কিছু বলছে না – তারা তাদের চোর বলছে।”
“আগেও তারা চা-ওলা বা পকোড়া-ওলার মতো যারা মেহনত করে খেটে খায় তাদের অপমান করেছিল।”
“বেইমানির অর্থে যারা খাচ্ছে, শুধু তারাই কংগ্রেসের চোখে সম্মানিত – আর চা-ওলা, পকোড়া-ওলা, চৌকিদারের মতো মেহনতীরা অপমানের শিকার।”
তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী মোদী এর আগে যেভাবে নিজের চা-ওলা পরিচয়কে দারুণভাবে বিপণন করতে পেরেছিলেন, একইভাবে নিজেকে চৌকিদার বলে জাহির করে দুর্নীতির অভিযোগকেও ভোঁতা করে দিতে পারবেন?
কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র ও শিলচরের এমপি সুস্মিতা দেব অবশ্য তা মনে করেন না।
মিস দেব বিবিসিকে বলছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেকে দেশের প্রধান সেবক ও চৌকিদার বলে বর্ণনা করেছিলেন।”
“কিন্তু সেই চৌকিদারের বিরুদ্ধেই এখন রাফায়েল কেনায় চুরির অভিযোগ উঠেছে।”
“আর সেই চুরির অভিযোগ ঠেকাতেই তিনি আক্রমণাত্মক খেলার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হবে না, ওনার রাফায়েল কেলেঙ্কারি ধরা পড়বেই।”
“এর আগে তিনি নিজেকে চা-ওলাও বলেছিলেন, কিন্তু তিনি কোনও দিন চা বিক্রি করেছেন সে প্রমাণ মেলেনি।”
“নিজেকে চৌকিদার বলে দাবি করে বিতর্কের ন্যারেটিভটা বদলে দেওয়ার চেষ্টাও সফল হবে না।”
“আর দেশের যে সব মানুষ আধপেটা খেয়ে ঘুমোতে যান কিংবা মূল্যবৃদ্ধির আঁচ যাদের পকেটে লাগে তারা টুইটারও ফলো করেন না, ফেসবুকও দেখেন না – কাজেই এসব গিমিকে তাদের কিছু আসে যায় না”, বলছিলেন সুস্মিতা দেব।
দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোমা চৌধুরী আবার বিবিসিকে বলছিলেন, “সমাজে চৌকিদার আসলে যার হওয়া দরকার, সেটা হল মিডিয়া।”
“কিন্তু দেশের মিডিয়াই ভয়ঙ্কর আত্মসমর্পণ করে বসে আছে – ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর ওপর তারা সতর্ক নজর মোটেই রাখতে পারছে না। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোকে তো মনে হচ্ছে যেন কর্তৃপক্ষেরই একটা সম্প্রসারণ!”
কিন্তু তাহলে চৌকিদার স্লোগান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এই টানাটানি কি আসন্ন নির্বাচনে কোনও প্রভাবই ফেলবে না?
মিস চৌধুরীর মতে, “এগুলো আসলে দিল্লি-ভিত্তিক বা সোশ্যাল মিডিয়া-কেন্দ্রিক কিছু মানুষের জন্য তৈরি করা ‘নয়েজ’ বা গোলযোগ, কিন্তু দেশের মানুষ এসব দেখে ভোট দেন না।”
“আমরা আগে বারবার দেখেছি ভারতীয় ভোটাররা খুব পরিণত, নিজেদের প্রয়োজন বুঝেই তারা কখনও অমুক দলকে সাজা দিয়েছেন, আবার তমুক দলকে পুরস্কৃত করেছেন।”
“আর তার আগে এই চৌকিদার-বিতর্কটা নির্বাচনী রাজনীতির বিনোদনেরই অংশ বলে আমার ধারণা”, বলছেন মিস চৌধুরী।
পাঁচ বছর আগে ভারতে নির্বাচনের সময় চা-ওলা বা চা-বিক্রেতারা যেরকম আইকনে পরিণত হয়েছিলেন, রাজনৈতিক তরজার সূত্র ধরে এবারেও সেই একই জিনিস ঘটছে বাড়ি বা অফিসের নিরাপত্তারক্ষী, অর্থাৎ চৌকিদারদের সঙ্গে!