মানুষ সর্বজ্ঞানী নয় যে, তারা সর্ব বিষয়ে পারদর্শিতা দেখাতে পারবে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যদি কেউ জিপিএ-৫ না পায় তাহলে সে যেন মনুষ্যজাতিতেই পড়ে না! তার দিকে সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অন্যদিকে ফেল করা কিংবা জিপিএ-৫ যারা পায়নি তারা মনে করে তাদের জীবন ষোল আনাই বৃথা। এরকম মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা আমাদের মাঝে ইদানীং বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ভালো দিক হচ্ছে এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। মন্দ দিক হচ্ছে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে জীবনের সার্থকতা ভেবে জিপিএ-৫ না পাওয়া কিংবা ফেল করায় হীনম্মন্যতায় ভোগে। পরিবার, বন্ধু সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না কিংবা জীবন নাশের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। একটা লোমহর্ষক ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক বাচ্চা মেয়ে জেএসসিতে সাধারণ বিজ্ঞান পরীক্ষায় ফেল করায় কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নেয়। এরকম ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের ফলাফল, তার জীবন নাশের ফলাফলে রূপ নিল। সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বহুকাল থেকেই আমাদের দেশে প্রশ্নবিদ্ধ।
সবার মেধা সর্বদিকে সমান থাকে না এটাই সর্বজনীন। কেউ কারিগরি শিক্ষায় ভালো, কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় শতকরা হার বেশি। আমাদের দেশে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণীয় হয় বটে কিন্তু তা প্রয়োগ করার, ব্যবহার করার সুযোগ কোথায়? শিক্ষার্থী অনুযায়ী আমাদের দেশে গবেষণাগার সীমিত, প্রেক্ষাপট সীমিত। স্বাভাবিকভাবেই মগজ খাটিয়ে শেখার চেয়ে হাতেকলমে তার চেয়ে অতি দ্রুত এবং সহজেই আয়ত্ত করতে পারে শিক্ষার্থীরা এবং হাতেকলমে শেখার মানুষের শতকরা হার অধিক।
আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রেক্ষাপটটা অত্যন্ত নাজুক। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে সবকিছু ব্যয় করে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই বেকার হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। আবার যাদের অর্থবিত্ত আছে তারা বিদেশে পাড়ি জমান। দেখা যাচ্ছে, মেধা আছে কিন্তু ব্যবহার করার প্রেক্ষাপট অপ্রতুল। সব মিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষার ফলাফল দেশের উন্নয়নে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রটাকে যদি উন্নত করা যায়, কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, জিপিএ’র মারপ্যাঁচে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না, সমাজে তিরস্কৃত হতে হবে না, জীবন ষোল আনাই বৃথার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা অচিরেই লাঘব হবে বলে মনে করি।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমানভাবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ছেলেমেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা কখনোই ভালো হয় না। যার যে দিকে ঝোঁক, যে দিকে সে পারদর্শী তাকে দিয়ে সেই কাজটা করালে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? লক্ষণীয় বিষয় এই যে, কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রকে উন্নত করলে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধরাবাঁধার নিয়ম পরিত্যাগ করে বিকল্প কিছু করার, চিন্তা করার সুযোগ তৈরি হবে। যেন বলতে পারি, আমি জিপিএ-৫ পাইনি, তো!