Latest News
কালিহাতীতে বজ্রপাতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু
মে ১৮, ২০২৪
গোবিন্দগঞ্জে ২১ কেজি গাঁজা জব্দ
মে ১৮, ২০২৪
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
আর কয়দিন বাদেই ফুটবল বিশ্বকাপ। আয়োজক দেশ রাশিয়া প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে এবারের আসরকে সর্বকালের সেরা আয়োজনের রূপ দিতে। বিশ্বফুটবলের কর্ণধার ফিফাও তা-ই চায়। চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিচ্ছে তাদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। পৃথিবীর সবখানে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এখন চলছে রাশিয়া বিশ্বকাপের ক্ষণগণনা। দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত আপডেট দিচ্ছে ২১তম বিশ্বকাপের নানা তথ্য দিয়ে। কারা আছেন আর্জেন্টিনা দলে, ব্রাজিল দলে কে নেই, নেইমার কি এবার অধিনায়কত্ব করবেন, কেমন হয়েছে গতবারের বিশ্বকাপজয়ী দেশ জার্মানির এবারের দলটি, এবারও কি তারা পারবে শিরোপা ধরে রাখতে, নাকি শেষ পর্যন্ত সেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল না নতুন কেউ বিশ্বকে চমকে দিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের মালিকানা গ্রহণ করবে, আহা এবার ইতালি নেই, রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট পেলে এবার তারাই বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলত ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আর চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে। আর এসবের সঙ্গে আমার দেশের ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের উন্মাদনা তো আছেই। পছন্দসই নিজ দলের বৃহৎ বৃহৎ পতাকা তৈরি, এলাকায় এলাকায় বড় পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা, প্রিয় দলের সমর্থনে র্যালি, নিজ নিজ আইডি থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রপাগান্ডা, বাড়ির ছাদে দলের পতাকা ওড়ানোÑ সবই চলছে।
গত ১৯ মে একটি অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুর এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন টুটুল নামের এক সমর্থক তার প্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসার নজির সৃষ্টি করতে নিজের ছয়তলা বাড়িটি ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন। তিনি ২০১০ সালের বিশ্বকাপের সময়ও ব্রাজিলের পতাকার রঙে বাড়ি সাজিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বাড়ির নাম দিয়েছেন ‘ব্রাজিল বাড়ি’। তার সেই বাড়ির ছাদে এখন উড়ছে ব্রাজিলের পতাকা।
এছাড়া আমজাদ হোসেন নামের জার্মান ফুটবল দলের এক অন্ধ ভক্ত তার প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা পতাকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। মাগুরা সদর উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন ২০১৪ সালের বিশ্বকাপেও তার প্রিয় দল জার্মানির সাড়ে তিন কিলোমিটার পতাকা বানিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন।
এসবের বাইরে খেলায় প্রিয় দলের পরাজয় সইতে না পেরে সমর্থকদের মৃত্যুর সংবাদও আমরা শুনতে পাই। গেল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পরাজয়ে দুইজনের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছিলাম। অথচ কী আশ্চর্য সেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় কিন্তু এ রকম মৃত্যুর সংবাদ আমরা শুনতে পাই না। আরও অবাক করা তথ্য হলো, যেসব দেশের ফুটবল দলের জন্য আমার জান-প্রাণ বাজি রেখে উৎসবে মেতে উঠি, তারা কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না।এই সময়ের গণমাধ্যমে একটু দৃষ্টি রাখলে চোখে পড়বে ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে এমন চমকপ্রদ নানা খবর।
আমরা বাঙালিরা ফুটবলপ্রেমী জাতি- এটি নতুন কোনো কথা নয়, অনেক পুরানো। বলতে হবে একসময় শুধু এই ফুটবলই আমাদের নির্মল আনন্দে মাতিয়ে রাখত। শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয়, শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই যেন ছিল ফুটবলের জয়জয়কার। খেলার মাঠে আবাহনী-মোহামেডানে বিভক্ত হয়ে যেত পুরো দেশ। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। নিজ দলের জার্সি পরে ঢোল-করতাল নিয়ে হাজির হতো সমর্থকরা। খেলার টিকিট কালোবাজারি হতো। মনে পড়ে মফস্বল শহরে টিকিট কেটে আমরাও ফুটবল খেলা দেখেছি।
শহিদুর রহমান চৌধুরী সান্টু, মনোয়ার হোসেন নান্নু, কাজী সালাউদ্দিন, আবু ইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, আবদুস সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, শফিকুল ইসলাম মানিক, ছাইদ হাসান কানন, কায়সার হামিদ, সম্রাট হোসেন এমিলি, মোনেম মুন্না, সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, সাইফুল বারী টিটু, জুয়েল রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, আরমান মিয়া, আলফাজ আহমেদ, আরিফ খান জয়, আমিনুল হক কিংবা রজনীকান্ত বর্মণের ফুটবল নৈপুণ্য দেখে উজ্জীবিত হয়ে উঠত পুরো জাতি।
কিন্তু আজ! সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র আমাদের সামনে। সময়ের বিবর্তনে দেশের ফুটবল আজ প্রায় তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। এই সময়ে দেশ এগিয়েছে, দেশের অর্থনীতি সংহত হয়েছে, বেড়েছে আর্থিক সামর্থ্য, সেইসঙ্গে বেড়েছে প্রযুক্তিসহ নানা সুযোগসুবিধা, খেলার মাঠ বেড়েছে, ফুটবল ফেডারেশন আধুনিক হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে খেলা ক্লাবগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিপুল অঙ্কের টাকা স্পন্সর করার মতো একাধিক প্রতিষ্ঠান দেশেই গড়ে উঠেছে; কিন্তু এর বিপরীতে এক বিন্দুও অগ্রসর হয়নি আমাদের প্রিয় ফুটবল। প্রতিবেশী দেশগুলো, যাদের আমরা একসময় হামেশাই হারাতাম, আজ সেই তাদেরই হারানো যেন আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। ক্রমে ক্রমে বিশ্বফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা র্যাংকিংয়েও আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। ২০১৭ সালের ফিফা র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ১৯০তম দল। প্রতিবেশী দেশ ভারত যেখানে বাংলাদেশ থেকে ১৪-১৫ ধাপ পিছিয়ে থাকত, সেই ভারত গেল বছর আমাদের পেছন ফেলে বিশ্বফুটবলের ৯৬তম দল হয়ে ওঠে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের এই ডামাডোলের মাঝে আরও একটি সংবাদ আমাদের নজর কাড়ে। একটি সংবাদভিত্তিক অনলাইনে প্রকাশিত নিউজটির শিরোনাম ছিল এ রকম- ‘আবারও অনভিজ্ঞ কোচের হাতে বাংলাদেশের ফুটবল।’ আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি, তবে কি আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব? অনলাইনটি বলছে, সাবেক কোচ অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু ওর্ড চাকরি ছাড়ার পর একজন নতুন বিদেশি কোচ খুঁজছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। প্রায় দেড় মাস পর নতুন কোচ চূড়ান্ত করতে পেরেছে তারা। এবার লাল-সবুজ জার্সিধারীদের দায়িত্ব নিতে আসছেন একজন ব্রিটিশ কোচ। জেমি ডে নামের ৩৮ বছর বয়সের এ কোচ জুনের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় আসার কথা।
ফুটবলে কোচ আসা-যাওয়া নতুন কিছু নয়। সে ধারাবাহিকতায় আরেকজন বিদেশির নাম যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল দলের কোচের তালিকায়। জেমি হবেন বাংলাদেশের ২১তম বিদেশি এবং দ্বিতীয় ব্রিটিশ কোচ। এর আগে ২০০২ সালে মার্ক হ্যারিসন নামের এক ইংলিশ অল্প দিনের জন্য বাংলাদেশের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। দেড় মাস আগে চাকরি ছেড়ে যাওয়া অ্যান্ড্রু ওর্ডের মতো নতুন কোচও অনভিজ্ঞ। আমরা জানতে পারি, কোনো দেশের তো নয়ই, বড় কোনো ক্লাবের দায়িত্বও পালন করেননি জেমি। বাংলাদেশের আগে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের পঞ্চম বিভাগ লিগের ক্লাব ব্যারো এফসির সহকারী কোচ।
এভাবে গত আট বছরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের চেয়ার বদল হয়েছে ১৫ বার! সাইফুল বারী টিটু তিন মেয়াদে জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন কোচ মারুফুল হক। সাইফুল বারীর মতো তিন দফা কোচের দায়িত্ব পালন করেন নেদারল্যান্ডসের লোডউইক ডি ক্রুইফ। এ সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন করে গেছেন সার্বিয়ার জোরান দর্দেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচ, মেসিডোনিয়ার নিকোলা ইলিয়েভস্কি, ইতালির ফ্যাবিও লোপেজ, স্পেনের গঞ্জালো সানচেজ মরেনো, বেলজিয়ামের টম সেইন্টফিট, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড্রুু অর্ড। এ তালিকার সর্বশেষ নাম জেমি ডে।
গণমাধ্যম সূত্রে আমরা আরও জানতে পারি, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ সময় কাজ করেছেন মাত্র চারজন কোচ। মালদ্বীপে কাজ করেছেন নয়জন কোচ। নেপালের জাতীয় দলেও এ সময় কাজ করেছেন নয়জন কোচ। এই কোচ নিয়োগ ইস্যুতে ভারত, মালদ্বীপ কিংবা নেপাল কিন্তু বাংলাদেশের মতো অস্থিরতা দেখায়নি। দেশ তিনটির খেলার নিজস্ব একটা ধরনও দাঁড়িয়েছে। ভারত বরাবরই এ অঞ্চলের পরাশক্তি ছিল, এখনও আছে। নেপালও ফুটবলে অনেক উন্নতি করেছে। মালদ্বীপ তো এখন সাফ অঞ্চলে ভারতের মূল চ্যালেঞ্জার। আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ!
প্রায় একদশক ধরে সাবেক কৃতী ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনের হাতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্ব। প্রশ্ন আসতেই পারে, বাফুফের শীর্ষপদে থেকে দেশের ফুটবল উন্নয়নে তিনি কী করেছেন? দেশীয় ফুটবলের হরানো গৌরব ফিরে আসা তো দূরের কথা, আমাদের ফুটবল এখন উল্টো পথেই হাঁটছে। বয়সভিত্তিক ফুটবল, আন্তঃজেলা ফুটবল, ক্লাব ফুটবল, জাতীয় লীগ কিংবা বহুদলীয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট- সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এই দুরবস্থা পেরিয়ে আমাদের প্রাণের ফুটবল জেগে উঠবে কবে? এই প্রশ্নটি শুধু আমার একার নয়, লক্ষ-কোটি ফুটবলপ্রেমী বাঙালির।
লেখক : সাংবাদিক।
Our facebook page